বাজেট ভাবনা
উন্নয়নের পূর্বশর্ত শিক্ষায় বরাদ্দ
একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত সে দেশের শিক্ষা। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। একটা সময় মনে করা হতো, যে দেশে যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ, সে দেশ তত বেশি উন্নত। কিন্তু এখন ধারণা পাল্টেছে। এখন মনে করা হয়, যে দেশে যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। মানব উন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশের উন্নয়ন বৈশ্বিক পর্যায়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অর্থনীতি, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রসহ প্রধান ১২টি উন্নয়ন সূচকের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ আজ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য বাংলাদেশকে আজ দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য নিরসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে অন্য দেশগুলোর সামনে।
জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষা খাতে মোট জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশও ২০০০ সালে এ প্রস্তাব অনুসমর্থন করেছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় আয়ের ২ শতাংশের সামান্য বেশি, অর্থাৎ বাজেটের ১১ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১৪ সালে বিশ্ব উন্নয়ন সূচকের (WDI) মতে, শিক্ষা খাতে জিডিপি বরাদ্দে ১৬১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম, যা আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশের চেয়েও কম।
রাজনীতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে শিক্ষাই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য ইতিবাচক হলেও শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে এবং পরিতাপের বিষয় হলো, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে তেমন কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করলেই তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। গত সাত বছরের শিক্ষা বাজেটে গড় বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৩.৭ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল সর্বোচ্চ (১৬.৩%)। সিপিডির মতে, বাংলাদেশে গত দুই দশকে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের জিডিপির বরাদ্দ সবচেয়ে নিচে অবস্থান করে। ২০১৪ সালে ভুটান ৫.৬ শতাংশ, আফগানিস্তান ৪.৬, নেপাল ৪.১, ভারত ৩.৯, পাকিস্তান ২.৫ ও বাংলাদেশ ১.৯ শতাংশ। (সূত্র : সিপিডি)
শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। এখানে একটি শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করা যায়। শিক্ষা বাজেটের সঙ্গে প্রযুক্তি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, ধর্মসহ নানা খাত জুড়ে দেওয়া হয়। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেটে সামরিক বাহিনী পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাদ্দও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বরাদ্দকৃত স্বল্প অর্থটুকুও ভাগাভাগি হয়ে যায় অন্যান্য খাতের সঙ্গে। শিক্ষা ও প্রযুক্তি দুটি আলাদা খাত হলেও বাজেটে এক করে দেখা হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরেও বরাবরের মতো শিক্ষা খাতের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কেও একত্র করে ‘শিক্ষা ও প্রযুক্তি’ নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট ৫২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ ভাগ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের চেয়ে ৩ দশমিক ১ ভাগ বেশি। গত বছর মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬ ভাগ এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। যেখানে মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শুধু শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা, সেখানে তথ্য ও প্রযুক্তি যোগ করে বাজেট করার ফলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ শতাংশেরও কম।
শিক্ষা খাতে পরিপূর্ণ বাজেট দিতে হলে তথ্য ও প্রযুক্তি বাদ দিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ভাগ করে সেক্টর ওয়াইজ বরাদ্দ দিতে হবে। আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৭.৮৮ শতাংশ। বিদায়ী (২০১৫-১৬) অর্থবছরে ছিল ৭.৬৬ শতাংশ। তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, গতবারের চেয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। টাকার পরিমাণের পাশাপাশি শতাংশের হিসাবে শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও তা এখনো যথেষ্ট নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোয় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আমাদের থেকে অনেক বেশি। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট খাতে আরো বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
আমাদের মতো জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা খুবই জরুরি। এই ১৬ কোটি জনগণকে উৎপাদনশীল করতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগই স্থায়ী বিনিয়োগ। তবে শুধু বরাদ্দ বেশি করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক ও মানসম্পন্ন গবেষণা। শিক্ষায় বরাদ্দ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে মান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে হবে। অবশ্যই এ বরাদ্দ যথার্থ ব্যয় করতে হবে এবং এর যাতে কোনো অপচয় না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে।
শিক্ষা খাতের বরাদ্দ উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে ভাগ করা হয়। বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগ অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়। অন্যদিকে উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয় সামান্যই। বরাদ্দের ক্ষেত্রে উন্নয়ন খাতকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা সম্ভব নয়। অবকাঠামোর দেখভাল, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ সরবরাহ ও সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োজিত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন অনুন্নয়ন খাতের অংশ এবং এই ক্ষেত্রগুলোতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সীমিত সম্পদকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় উন্নয়ন খাতের তুলনায় বেশি হওয়াটা অনভিপ্রেত। উন্নয়ন খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গবেষণা কার্যক্রম, শিক্ষার এই খাতে খুবই লজ্জাজনক বরাদ্দ। ‘মৌলিক গবেষণাশূন্য ১৫ গবেষণাকেন্দ্র’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এক শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি গবেষণাগারের জন্য বরাদ্দ ছিল সাড়ে ২৪ লাখ টাকা, যা মানসম্মত গবেষণাকাজ পরিচালনার জন্য নিতান্তই অপ্রতুল।
শিক্ষায় বেশি বিনিয়োগ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ফিলিপাইনের উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। ফিলিপাইনের ১৫ লাখ মানুষ প্রবাসী। তারা সবাই শিক্ষিত বিধায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠায়। আর বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ প্রবাসী, কিন্তু অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বলে রেমিট্যান্স পাঠায় মাত্র ১৫ বিলিয়ন। কারণ, শিক্ষিতরা সব সময়ই এগিয়ে থাকে। শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কোনো খরচ নয়, বরং টেকসই বিনিয়োগ। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের মতে, শিক্ষাই একমাত্র বিনিয়োগ, যেখানে ২৯ শতাংশ রিটার্ন অর্জন করা যায়। একটি দেশকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধ করার দরকার নেই, পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিলেই জনগণ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সমসাময়িক সময়ে স্বাধীন হলেও শুধু শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে অনেক উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য দরকার সরকারের আন্তরিকতা ও সচেতনতা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।