আন্তর্জাতিক
সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস নাকি সাংস্কৃতিক সংঘাত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাস-সংঘাত প্রায়ই ঘটছে। কিন্তু এবারের ঘটনার ব্যাপ্তি এবং মৃত্যু অনেক ভয়াবহ। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ—অরলান্ডো শহরে সমকামীদের একটি নাইট ক্লাবে এক সন্ত্রাসী বন্দুকধারীর হামলায় কমপক্ষে ৫০ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরো ৫৩ জন। নিহতের বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করে জানিয়েছে, পুলিশি প্রতিরোধে ওই হামলাকারীও নিহত হয়েছে। পালস নামে ওই ক্লাবটিতে রোববার গভীর রাতে এই বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ করেছে। তার নাম ওমর মতিন। বয়স ২৭। হামলাকারীর বসবাস ঘটনাস্থল থেকে ১০০ মাইল দূরে ফ্লোরিডার সেন্ট লুসিয়াতে। জানা গেছে, ওমর মতিন আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। ঘটনার দুদিন আগে আরো একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে।
ওই একই এলাকায় এক কনসার্টে এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন ২২ বছর বয়সী জনপ্রিয় পপ সংগীতশিল্পী ক্রিস্টিনা গ্রিনি। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, এটিকে একটি সন্ত্রাসী হামলাই মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেকোনো ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক সংযোগ খোঁজা হয়। যথারীতি এফবিআই ইসলামী চরমপন্থীদের দায়ী করছে। পুলিশও এফবিআইর সঙ্গে সুর মিলিয়েছে। তারাও বলছে, এটি বিদেশি সন্ত্রাসী হামলা।
গোটা বিশ্বব্যাপী প্রবণতাটাই এ রকম যে, কোনো কিছু ঘটলেই মুসলিম সন্ত্রাসীদের দোষ দেওয়া হয়। আর এর সমর্থনে এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মরত কিছু সংগঠন। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘সাইট’ নামক সংগঠনের কথা বলা যায়। বাংলাদেশে যখন প্রত্যন্ত গ্রামের একজন জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে ‘সাইট’ এটি আইএসের কর্মকাণ্ড বলে প্রচার করে। বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত করেই বলছে, দেশে কোনো আইএস নেই। অথচ ‘সাইট’ বলছে আইএস আছে। পরে সংবাদপত্রে পুলিশ সূত্রে প্রকাশিত হয় যে, ‘সাইট’ হচ্ছে এক ইহুদি মহিলার নিজস্ব সংগঠন। হয়তো বিশ্বের তাবত আহত-নিহতের ঘটনা আইএসের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াই তার কাজ। সন্দেহ করা যায়, বিশ্বব্যাপী চক্রান্তের জাল বিস্তার করে যে মোসাদ চক্র ইহুদি স্বার্থ রক্ষা এবং মুসলিম স্বার্থ কলুষিত করার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটিও তাদের চক্রান্তের একটি। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, কোনোরকম সরাসরি সম্পৃক্ততা বা আইএসের তরফ থেকে কোনো ঘোষণা ছাড়াই কোনো কোনো সংবাদ সংস্থা এটিকে আইএসের কাজ বলে খবর প্রচার করেছে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বলছে, হত্যাকারী যুবক ওমর মতিনের সঙ্গে আইএসের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সন্দেহ পোষণ করছেন, ঘটনাটি হামলাকারী মতিনের একক কাজও হতে পারে। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এই হামলা? যদি সংঘবদ্ধ হামলা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সংযোগ খোঁজা যেতে পারে। কিন্তু যদি একক পরিকল্পনায় হামলা সংগঠিত হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে হামলাকারীর আদর্শ, বিশ্বাস ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ফসল এটি।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সম্মিলিতভাবে সারা পৃথিবীতে এক ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ চলছে। যে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে গেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এসপি হান্টিংটন। এই ইহুদি বুদ্ধিজীবী আগামী পৃথিবীতে ‘সভ্যতার সংঘাত’ প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order (1996) এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছেন। অবশেষে রাষ্ট্রিক লড়াইয়ে যে আশঙ্কা হান্টিংটন করেছেন, তার প্রকাশ ঘটছে ছোটখাটো ব্যক্তিক এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনার মাধ্যমে। সভ্যতার এই শীর্ষ পর্যায়ে ধর্মের নামে এই জিকির এবং সহিংসতা একান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। আমরা সত্য-সুন্দর পরিশীলিত সংস্কৃতির দাবি করি। অথচ ইউরোপ ও আমেরিকায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলি প্রমাণ করছে আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছি। ধর্মনিরপেক্ষতা যে ইউরোপের প্রাণপাখি, তারা আজ ধর্মের নামে মানবতার অপমান করছে। দুস্থ-দুর্গত ও কষ্ট-ক্লিষ্ট মানুষ যখন ইউরোপীয় সভ্যতার পাদপ্রান্তে কশাঘাত করছে—একটু আশ্রয়ের জন্য, নির্ভয়ের জন্য এবং বেঁচে থাকার জন্য। তখন তারা প্রশ্ন করছে, ‘তুমি মুসলিম নাকি খ্রিস্টান?’ খ্রিস্টান হলে তোমার আশ্রয় আছে আর যদি তুমি মুসলিম হও, তাহলে ইউরোপের মাটিতে তোমার জায়গা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, ধর্ম একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। ধর্ম একান্তই নিজ আবেগ ও অনুভূতির বিষয়। দেহকে যেমন আত্মা থেকে অস্বীকার করা যায় না, ঠিক তেমনি ধর্মকে ব্যক্তি হৃদয় থেকে মুছে দেওয়া যায় না।
ইউরোপের সভ্যতা শিখিয়েছে, মানুষের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। অথচ ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র প্যারিস বলছে, হিজাব পরা বেআইনি। অথচ এই সেদিনও তারা ধর্মীয় প্রতীক ও ধর্মীয় অনুভূমি রক্ষায় কথা বলেছে। প্যারিস, নেদারল্যান্ডস অথবা অন্যত্র যখন ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ এবং পবিত্র পয়গম্বরকে নিয়ে কুৎসিত কথা লেখে, ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করে তখন তারা স্বাধীনতার নামেই এসব করে। স্বাধীনতা কখনই অবাধ স্বাধীনতা বা Laissez Faire নয়। তাদেরই রুশো বলেছেন, ‘মানবজাতি সর্বত্রয় নিয়মকানুন-শৃঙ্খলায় আবদ্ধ।’ ইউরোপ-আমেরিকার এই সাংস্কৃতিক পরিচয়টি তুলে ধরলাম এই জন্য যে, আমরা ফ্লোরিডার ওরলান্ডের হামলাকারী যুবকের মনঃস্তত্ত্ব বুঝতে চাই। জন্মগতভাবে ওমর মতিন একটি বিশ্বাসকে ধারণ করে। সে তার পবিত্র গ্রন্থে শিখেছে যে, সমকামীরা অন্যায় করছে। অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এসব কর্মকাণ্ড নাইট ক্লাবের নৃত্য তাকে হয়তো ক্ষুব্ধ করে থাকবে, কিন্তু তার অর্থ কী এই যে, সে তার ঘৃণাকে সশস্ত্রভাবে প্রতিভাত করবে? এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের সকলের সহজ জবাব, না সে তা করতে পারে না। কেননা, সে একটি কাঙ্ক্ষিত, পরিশীলিত শিক্ষায় জীবন অতিবাহিত করেছে। তার ধর্ম, শিক্ষা, সামাজিকতা তাকে মানুষ হত্যা করার অধিকার দেয় না।
মনীষী অ্যারিস্টটল বলছেন, ‘তোমার চেহারা তুমি ছোট আয়না দিয়েও দেখতে পারো, আবার বড় আয়না দিয়েও দেখতে পারো।’ ওমর মতিন যদি ছোট আয়না হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপকে বড় আয়না বলা যায়। পৃথিবীর সব জাতি ও রাষ্ট্র যদি স্বাধীন হয়, তাহলে সেই সব স্বাধীন দেশে স্বাধীন সংস্কৃতি অনুসরণে বাধা দেওয়ার বৈধ অধিকার কি পাশ্চাত্য ধারণ করে? একটি আফগানিস্তানে তালেবান শাসন চলবে নাকি গণতন্ত্রের শাসন চলবে, সেটি নির্ধারণ করা মালিক-মোক্তার কারা? একটি ইরাকে শিয়া শাসন চলবে নাকি সুন্নি শাসন চলবে, সেটি নির্ধারণ করার মালিক কারা? একটি লিবিয়ায় গাদ্দাফি স্বৈরশাসক নাকি জনপ্রিয় শাসক তা নির্ধারণ করবে কারা? স্ব-স্ব দেশের জনগণ নাকি ক্ষমতাধর পাশ্চাত্য? যদি তারা সত্যিকার গণতন্ত্রের রপ্তানিকারক হয়ে থাকে, তাহলে মিসরে একটি নির্বাচিত সরকারকে বাতিল করে সেনাশাসন কীভাবে আসে?
আলজেরিয়ায় গণতন্ত্রের বিজয় নস্যাৎ করার জন্য কীভাবে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে? কীভাবে নাইজেরিয়ায় একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে তিলে তিলে কারার অন্তরালে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়? কে বা কারা ব্যক্তি ওমর মতিনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মনঃস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়? একটি দেশের জাতি ও আদর্শকে, জীবনবোধকে অস্বীকার করে রপ্তানীকৃত মতবাদ চাপিয়ে দিতে চাই। আর গণতন্ত্র? মিসর, আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া কি প্রমাণ করে? তারা কি সত্যিকার গণতন্ত্র অনুশীলনেও ব্যর্থ? সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে এরূপ হাজারো ওমর মতিনের মনঃস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। কেন একটি রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? আর তাতে জ্বলেপুড়ে ছারখার গোটা মুসলিম জনপদ।
পাপে পাপ আনে পুণ্যে আনে সুখ। নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী Every action has its equal and opposite reaction’ প্রতিটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে এসব তত্ত্বকথা বুঝতে হবে। আর ওমর মতিনদেরও বুঝতে হবে সন্ত্রাস সমাধানের পথ নয়। ইসলাম বলে, যে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করল সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং প্রতিকার হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পথে। সন্ত্রাস ও বিদ্বেষের মাধ্যমে নয়। বিশ্ব নেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলসহ সকলে এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। গোটা বিশ্ববাসী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আমরাও অংশীদার। আমরাও এ ধরনের নির্দয়-নিষ্ঠুর-নির্মম হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।