ব্রেক্সিট
ব্রিটিশদের রায় ও ক্যামেরনের পদত্যাগ

সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হলো সহনশীলতা ও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর ব্রিটেনের জনপ্রতিনিধিরা জনরায়ের প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধাশীল থেকে সমাজে সহনশীলতা আর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর। ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হওয়ার পক্ষে গণরায় আসার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পদত্যাগের ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারই প্রমাণ পাওয়া গেল। ব্রিটেন রাজতন্ত্র থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ করেছে প্রায় তিনশো বছর আগে। সংসদীয় গণতন্ত্রে সারা বিশ্বের কাছে ব্রিটেন এক অনন্য ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। আর ক্যামেরনের এই পদত্যাগের ঘোষণা ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
ডেভিড ক্যামেরনের এই পদত্যাগ দুটো দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এক. জনমত ও জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধার দৃষ্টিকোণ থেকে। দুই. ক্ষমতা কাঠামো বা শাসনব্যবস্থার বাইরের কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া।
ডেভিড ক্যামেরুন জনরায়ের প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, তার নজির বর্তমান বিশ্বে বিরল। তাঁর পদত্যাগের জন্য জনগণের পক্ষ থেকে কোনো দাবি ছিল না। কোনো দল কিংবা গ্রুপ থেকে ন্যূনতম আন্দোলনও গড়ে ওঠেনি। এমনকি তাদের দলের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছিল তিনি পদত্যাগ করবেন না। কিন্তু সম্পূর্ণ নৈতিক দায় থেকে তিনি সরে দাঁড়ালেন। ইইউ প্রশ্নে তাঁর যে অবস্থান, সেটার বিপরীত মত জয়ী হওয়ায় তিনি মনে করেন নতুন নেতৃত্বের অধীনে দেশের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সমীচীন। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে দেওয়া তাঁর বক্তব্যেও সেই রকম আভাসই পাওয়া যায়। সেখানে তিনি জানান, জনগণের নতুন নির্দেশনার আলোকে দেশকে এগিয়ে নিতে পরিচালকের ভূমিকা পালন করা তাঁর জন্য সঙ্গত নয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস তা যেন তিনি আরেকবার প্রমাণ করলেন। আর তাই তো তাঁর পদত্যাগ ঘোষণার সময় বলেছেন, ‘ব্রিটেন শুধু সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসরণই করে না, জনমত নিয়ে কীভাবে দেশ শাসন করতে হয় সেটাও ব্রিটেন দেখিয়ে দিয়েছে।’ তাঁর এই বক্তব্য ব্রিটেনের গণমানুষের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর লক্ষকোটি গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্যও।
ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে ব্রিটেনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে ব্রিটেনের জনগণের এক অনন্য ইতিহাস রয়েছে। যুগে যুগে কালে কালে তারা তাদের অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত ম্যাগনাকার্টা থেকে শুরু করে বিল অব রাইটস কিংবা গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ, সব ক্ষেত্রেই ব্রিটেনের জনগণের সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ ছিল। নিজেদের স্বকীয়তা আর নিজস্বতা বজায় রাখতে এবার আরেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। অনেকের দৃষ্টিতে এটি দক্ষিণপন্থী গোড়া জাতীয়তাবাদী প্রভাব হলেও এই গণভোট তাদের নিজস্বতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। সেই রায়ের প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মান জানিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যেন ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকেই সম্মান জানালেন।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের প্রধান হিসেবে নিজের অপরিহার্যতাও তিনি বিভিন্নভাবে প্রমাণ দিয়েছেন। তাঁর শাসনামলে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করা হয়। কিন্তু তাঁর প্রতি এবং ব্রিটেনের প্রতি যে স্কটিশদের সমর্থন রয়েছে তা প্রমাণিত হয়েছে। ৫৫ শতাংশ স্কটিশ ব্রিটেনে থেকে যাওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছিল। সেই স্কটিশরা এবারও তাঁর মতের প্রতি সমর্থন দিয়ে ইইউতে থাকার পক্ষেই মত দিয়েছে। কিন্তু সমগ্র জনগণের ৫১.৯ শতাংশ মানুষ যে রায় দিয়েছে সেটাকেই মাথা পেতে নিলেন টোরি নেতা ডেভিড ক্যামেরন।
ক্ষমতা কাঠামো ও ক্ষমতা রদবদলের বাইরের কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে একজন সরকারপ্রধান পদত্যাগ করতে পারেন, সেই ক্ষেত্রেও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। সাধারণত দেখা যায়, জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে না পারলে কিংবা গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার মসনদ থেকে পদত্যাগ করে। কিন্তু ব্যতিক্রম একটি ইস্যুতেও যে পদত্যাগ করা যায় তা তিনি দেখিয়েছেন। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, সম্পূর্ণরূপে গণভোটের রায়কে সমুন্নত করার স্বার্থেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
নিকট অতীতে অনেক রাষ্ট্রেই শাসকগোষ্ঠী গণভোটকে তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর অনেক উদাহরণ আছে। সামরিক শাসন আমলে বাংলাদেশের শাসকরা নিজেদের সমর্থন যাচাই করতে এ ধরনের গণভোটের আয়োজন করে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সেই সব গণভোট। ফলে গণভোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে। কিন্তু ব্রিটেনের এই গণভোটের আয়োজন প্রমাণ করে গণভোটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। আর ক্যামেরনের পদত্যাগ জাতীয় প্রয়োজনে জনরায় তথা গণভোটকে আরো অপরিহার্য করে তোলে।
বলা হচ্ছে ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টির প্রভাবেই ব্রিটিশরা ইইউ ছাড়ার পক্ষে মত দিয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনীতির মাঠে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও ইউকিপ শুরু থেকেই ইউরো থেকে বের হয়ে আসার জন্য কট্টরপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে। অভিবাসন সমস্যা ও ইইউ ইস্যুতে তারা জনমত গঠন করতে সমর্থ হয়। যার প্রমাণ হিসেবে ২০১৩ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলটি বেশ ভালো করে। পক্ষান্তরে ডেভিড ক্যামেরন বলে আসছিলেন যে, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছিন্ন হওয়া দেশটির অর্থনৈতিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু জনগণ সেই যুক্তিকে আমলে না নিয়ে ইইউ ছাড়ার পক্ষেই মত দিল।
ক্যামেরনের পদত্যাগ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। হয়তো তিনি সামনের দিনগুলোতে ব্রিটেন যে সমস্যার সম্মুখীন হবে তা মোকাবিলা করতে চান না। অথবা তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বলে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এসব যুক্তি-তর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি জনরায়কে সম্মান জানিয়েছেন। এই জন্যই তিনি বলেছেন, ‘ব্রিটিশ জনগণের ইচ্ছা এমন এক নির্দেশ যা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।’ এই পদত্যাগ একদিকে যেমন তাঁর ব্যর্থতার পরিচায়ক, অন্যদিকে জনরায়কে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টাও বটে।
গণভোটের পর তিনি যে ভাষণ দিলেন, তা ব্রিটেনের ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে। এই গণভোট ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সিদ্ধান্ত। আর সেই জন্য তাঁর ভাষণে তিনি একদিকে যেমন দেশাত্মবোধের কথা তুলে ধরেন, অন্যদিকে সবাইকে তাঁদের দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। এই গণভোটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে যেন ফাটল না ধরে সেই ধরনের ইঙ্গিত দিয়ে ব্রিটেনের বহুত্ববাদী চরিত্রের কথা তুলে ধরেন।
ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছিলেন ‘ভয়েস অব দ্য পিপল ইজ দ্য ভয়েস অব গড’। সারা পৃথিবী সেই ‘ভয়েস অব দ্য পিপলের’ শক্তি দেখল। জনগণের মতামত এক মূহূর্তে যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন থাকা ব্যক্তির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দিতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এই ঘটনা। কাউকে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ না দিয়ে, কোনো সমালোচনার জায়গা না রেখেই খুবই তড়িৎ গতিতে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন ক্যামেরুন। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার করতে থাকা মানুষের মনে আশার সঞ্চার হতে পারে। পৃথিবীতে যেসব শাসক জনরায়কে উপেক্ষা করে কিংবা বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকতে চান, তাঁরাও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।
লেখক : গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক