আন্তর্জাতিক
ব্রেক্সিটের নেপথ্যে
ব্রেক্সিটের থাবায় ব্রিটিশ রাজনৈতিক অঙ্গন এখন টালমাটাল। পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, বিরোধী নেতা জেরেমি করবিনের গদি নিয়ে টানাটানি চলছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, ব্রেক্সিট ফল নির্ধারণে অবশ্য করবিনের প্রভাব নিয়ে সংশয় ছিল। মার্কিন সংবাদমাধ্যম বলছে, করবিন গণভোটে ডেভিড ক্যামেরনকে কতটা সাহায্য করতে পারবেন, তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও নিশ্চিত ছিলেন না।
ঐতিহাসিক গণভোটের মাসখানেক আগে ক্যামেরনের টিম লেবার সমর্থকদের ভোট নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাদের দুশ্চিন্তার আরেকটি কারণ ছিল, করবিনের লোক দেখানো সমর্থন। পরিস্থিতি উত্তরণে ‘রিমেইন’ নীতিনির্ধারকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করবিনের যৌথ সভার পরিকল্পনা করেন। তাঁদের মতে, এটাই ছিল লেবার ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর সেরা রাস্তা। কিন্তু করবিন কোনো অবস্থাতেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমঞ্চে দাঁড়াতে রাজি ছিলেন না। সাবেক লেবার প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এ ব্যাপারে করবিনের সঙ্গে কথা বলেন বলেও জানিয়েছে গণমাধ্যম। কিন্তু করবিন তাঁর মনোভাব পরিবর্তনে রাজি ছিলেন না। ‘রিমেইন’ ক্যাম্পের সিনিয়র নীতিনির্ধারক ক্যামেরনের বিশ্বস্ত পিআর প্রধান ক্রেগ অলিভার এবং ওবামার প্রচার প্রধান জিম মেসিনা এ ঘটনায় হতাশ হয়ে পড়েন। এমনকি লেবার নেতারা তাদের রেজিস্টার্ড ভোটারের তালিকাও ‘রিমেইন’ কর্মকর্তাদের দিতে রাজি হননি। বিরোধী নেতাদের আশঙ্কা, আগামী সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি এ তথ্য কাজে লাগাবে।
পশ্চিমা গণমাধ্যম বলছে, এ অবস্থায় ‘রিমেইন’ নেতারা সরাসরি হোয়াইট হাউসের হস্তক্ষেপের কথাও চিন্তা করেছিলেন। এপ্রিলে লন্ডন সফরের সময় করবিনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ওবামা। সে সময় তাঁদের মধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গণভোট নিয়েও আলোচনা হয়। ইংল্যান্ডকে ইইউতে রাখতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার আশ্বাস দেন করবিন। কিন্তু ‘রিমেইন’ নেতারা মনে করেন, করবিন বাস্তবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেননি। ক্যামেরনের সঙ্গে একমঞ্চে না দাঁড়ানোর ব্যাপারে করবিনের অনমনীয় মনোভাবের ইঙ্গিত পেয়ে হোয়াইট হাউসকে ব্যবহারের চিন্তা বাদ দেন রিমেইন নেতারা।
সবকিছু মিলিয়ে যে প্রচার বিশেষজ্ঞরা ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ড গণভোট আর গত বছরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্যামেরনের জয় নিশ্চিত করেছিলেন, তাঁরা ইইউ ভোটে ব্যর্থ হয়ে যান।
জুনের শুরুর দিক থেকে ক্যামেরন শিবিরের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। একসময় জনমত জরিপে প্রায় ১০ ভাগ এগিয়ে থাকার লিড কমতে শুরু করেছিল। ‘রিমেইন’ শিবির শুরু থেকেই অর্থনৈতিক ইস্যুতে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শেষ সময়ে এসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায় অভিবাসী ইস্যু। এ ছাড়া ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের বিপুল উপস্থিতি জনমনকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তাই ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার নেতিবাচক অর্থনৈতিক দিকগুলো তারা বিবেচনায় নিতে রাজি ছিলেন না।
এদিকে, গণভোটে ‘রিমেইন’ আর ‘লিভ’ প্রশ্নে ক্যামেরন শিবিরে ভাঙন ধরে। প্রধানমন্ত্রীর দুই বিশ্বস্ত সহযোগী বরিস জনসন আর মাইকেল গোভ যোগ দেন লিভ শিবিরে। মূলত এর পরেই বিচ্ছিন্নভাবে ইইউ ছাড়ার পক্ষে প্রচার চালানো লিভ শিবির উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে একা হয়ে পড়েন ক্যামেরন। এমনকি কনজারভেটিভ এমপিরাও কোনো পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে রাজি ছিলেন না। আর করবিন ছিলেন নিরাপদ দূরত্বে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ব্রিটেনের থাকা না-থাকা প্রশ্নে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে গণভোটের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তিনটি বিষয় মাথায় নিয়ে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। এক, তার দল কনজারভেটিভকে ঐক্যবদ্ধ করা; দুই, কট্টর ডানপন্থী যুক্তরাজ্য ইনডিপেনডেন্ট পার্টির উত্থান ঠেকানো আর তিন, ইইউ গণভোট প্রশ্নে অনিশ্চয়তায় থাকা লেবার পার্টিকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়া।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের মতো কেউ কেউ গণভোটে ক্যামেরনের পাশে থাকলেও, শরণার্থীদের বাঁধভাঙা স্রোত আর গ্রিসের রণ বিতর্ক সব হিসাব এলোমেলো করে দেয়।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বলছে, চাপের মুখে ক্যামেরন প্রেসিডেন্ট ওবামার সহায়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু ইইউ না ছাড়তে ওবামার দেওয়া সতর্কবাণীও ভোটে কাজে লাগেনি। যদিও ওবামার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক তরুণ ভোটার হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছিলেন। তবে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ওবামার তির্যক মন্তব্য ব্রিটিশ ভোটাররা ভালোভাবে নেয়নি।
পাশাপাশি সাবেক লন্ডন মেয়র বরিস জনসনের আনুষ্ঠানিক সমর্থন লিভ শিবিরকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে তোলে। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র মনে করে, এটিই ব্রেক্সিট জয়ের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা। চৌকস জনসন এখন ক্যামেরনের প্রধানমন্ত্রী পদের সবচেয়ে বড় দাবিদার।
ব্রিটিশ গণমাধ্যমের মতে, এ মুহূর্তে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ জনসন। ইইউ ছাড়ার পক্ষে জনমত জোরদার করতে একটি লাল বাসে চড়ে তিনি গোটা দেশ চষে বেড়ান। গণভোটের দুই রাত আগে বিবিসি টিভি বিতর্কে তিনি ২৩ জুনকে ব্রিটেনের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। লিভ ক্যাম্পের সিনিয়র কর্মকর্তারা মনে করেন, জনসনের এই ঘোষণা সিদ্ধান্তহীন হাজার হাজার ভোটারকে প্রভাবিত করে। স্কুলজীবনের বন্ধু জনসনের মতো ক্যামেরনের মাথাব্যথার আরেক কারণ হয়ে দাঁড়ান একান্ত ঘনিষ্ঠ বিচারমন্ত্রী মাইকেন গোভ। ক্যামেরন আর গোভের স্ত্রীও ব্যক্তিগত বন্ধু। এমনকি তাঁদের সন্তানরাও পরস্পরের সঙ্গী। জনসন আর গোভ দুদিনের ব্যবধানে লিভ শিবিরে যোগ দেন। এবং ইইউ ছাড়ার পক্ষে প্রচারণায় ঝড় তোলেন। ইইউতে থাকার পক্ষে ক্যামেরনের মূল স্লোগান ছিল ‘শক্তিশালী, নিরাপদ আর ভালো থাকুন’। আর জনসনদের স্লোগান ছিল ‘নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নাও’। প্রচার বিশারদরা বলছেন, ক্যামেরনের স্লোগানের চেয়ে জনসনদের স্লোগান ব্রিটিশদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছিল।
শরণার্থীদের স্রোত ঠেকাতে ক্যামেরনের অঙ্গীকার ভঙ্গ জনমনে কত গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, তা সরকার ঘনিষ্ঠরা বুঝতেই পারেননি। তার সঙ্গে ছিল ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের চাপ, সব মিলে জনমত ছিল বিক্ষুব্ধ। তা ছাড়া আইন মেনে ভোটের চার সপ্তাহ আগে প্রচারণা থেকে সরে যেতে হয়েছিল সরকারি কর্মকর্তা ও বিভাগকে। তাই ‘রিমেইন’ শিবিরের অফিশিয়াল অ্যাডভান্টেজও চলে যায়। ফলে শেষ সময়ে টিভি সম্প্রচারে উভয় পক্ষই সমান সময় পায়।
গণমাধ্যম বলছে, লিভ শিবির প্রচারণায় তুরস্কের ইইউতে সম্ভাব্য যোগদান আর প্রতি সপ্তাহে ব্রাসেলসকে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড দেওয়ার মতো ইস্যুতে ঝড় তোলেন। যদিও বহুল আলোচিত এই দুই ইস্যুর একটিও পুরোপুরি তথ্যভিত্তিক নয় বলে মনে করেন পণ্ডিতরা। শরণার্থী ইস্যুতে আগ্রাসী প্রচারণা চালাতে থাকে লিভ শিবির। মে মাসের শেষ দিকে সরকারি একটি তথ্য তাদের প্রচারণার আগুনে ঘি ঢালে। জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তর জানায়, ২০১৫ সালে রেকর্ড তিন লাখ ৩৩ হাজার শরণার্থী লন্ডনে প্রবেশ করেছেন। ২০১০ সালে ক্যামেরন অভিবাসীর সংখ্যা কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিলেন। তাই গণভোটের ঠিক আগে শরণার্থী-সংক্রান্ত এ ঘোষণা তার বিপক্ষে যায়।
লিভ শিবিরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটারদের উৎকণ্ঠা তারা সফলভাবে নিজেদের পক্ষে নিতে পেরেছেন। এই কর্মকর্তাদের মতে, ভোটারদের তারা বোঝাতে পেরেছেন ব্রাসেলস থেকে নিয়ন্ত্রণ সরাতে পারলেই সীমান্তে অবাধ যাতায়াত বন্ধ হবে। কমবে হাসপাতাল আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ। তাদের সমস্ত প্রচারণার মূল মন্ত্র ছিল এটা। তাই তো এক ঘণ্টার টিভি বিতর্কে গোভ ২৩ বার ‘নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিন’ কথাটি বলেছেন। লিভ কর্মকর্তারা মনে করেন, ইইউতে থাকলে কী কী উপকার হবে, ব্রিটেনের জনগণকে রিমেইন কর্মকর্তরা এ কথা বোঝাতে পারেননি। তাঁরা শুধু বলেছেন, ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু কী কী ভাবে খারাপ হবে, তা তারা ঠিকমতো বোঝাতে পারেননি। এটাই ছিল দুই প্রচারণার মূল পার্থক্য।
জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বেশিরভাগ জনমত জরিপে এগিয়ে যায় লিভ শিবির। এটা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে আরো নার্ভাস করে তোলে। এ সময় ক্যামেরন শিবিরের কেউ কেউ অর্থনৈতিক বিষয়কে বাদ দিয়ে অন্যান্য প্রসঙ্গকে প্রচারণার মুখ্য ইস্যু করার দাবি জানান। কিন্তু ক্যামেরন ঘনিষ্ঠরা তাতে রাজি হননি। তাঁদের যুক্তি ছিল, আগেও বিভিন্ন নির্বাচনে মিডিয়ায় এ ধরনের জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নিজেদের কৌশলে অটুট থেকেই শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন তাঁরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সময় কনজারভেটিভদের লেবার পার্টির প্রত্যক্ষ সমর্থন প্রয়োজন ছিল। গণভোটের কয়েক সপ্তাহ আগে অভ্যন্তরীণ এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি পাঁচজনের একজন লেবার ভোটার পার্টির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নন। দলের অভিবাসন নীতি নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যে কর্মকর্তারা মাত্র এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীকে আবার ক্ষমতায় আনতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, ব্রেক্সিটের মতো আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ মোকাবিলায় তারা যথেষ্ট ছিলেন না। ক্যামেরনের রাজনীতি বাঁচাতে তাঁদের দরকার ছিল বয়স্ক আর হোয়াইট ভোটারদের সমর্থন। এমনকি অতীতে লেবার পার্টিকে ভোট দিয়েছেন এমন বহু মানুষও তাঁদের টার্গেট হতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করতে পারেননি, ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হলেন তাঁদের নেতা ডেভিড ক্যামেরন।
সাবেক লেবার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও গর্ডন ব্রাউন গণভোটে টোরিদের সঙ্গে প্রচারণায় রাজি ছিলেন। কিন্তু করবিন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে সাহায্য করতে রাজি ছিলেন না। সাধারণভাবে মনে করা হয়, প্রকাশ্যে রিমেইনের পক্ষে থাকলেও সমাজতন্ত্রী করবিনও বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউর পর খুশি ছিলেন না। এ ছাড়া ক্যামেরনের আয়োজিত গণভোটে তার পক্ষে দাঁড়ানোর কোনো কারণও তিনি খুঁজে পাননি। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ড গণভাটে ক্যামেরনকে সাহায্য করাটা দলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। করবিনের মতে, সে কারণেই এক বছর পর ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে স্কটল্যান্ডে লেবার পার্টির ভরাডুবি হয়। অবশ্য লেবার এমপি জো কক্সের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ক্যামেরনের সঙ্গে একমঞ্চে দাঁড়িয়েই শোক প্রকাশ করেন করবিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেছিলেন, কক্স হত্যাকাণ্ড ব্রেক্সিটের হাওয়া রিমেইন ক্যাম্পের দিকে ফিরিয়ে আনবে। বাস্তবে অবশ্য তা হয়নি। গণভোটে এ ঘটনার সামান্যই প্রভাব দেখা গেছে।
গণভোটের সকালেও রিমেইন ক্যাম্পের বিশ্বাস ছিল, জয় শেষ পর্যন্ত তাদেরই হবে। দোদুল্যমান লেবার ভোটাররাও শেষ পর্যন্ত পার্টির নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখে ইইউর পক্ষেই ভোট দেবেন বলে তাঁদের বিশ্বাস ছিল। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন ক্যামেরন।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভশন।