আন্তর্জাতিক
কাশ্মীরের আগুন নিভবে কবে?

বিশ্ব এক অস্থির সময় পার করছে। সম্ভবত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে এর চেয়ে খারাপ অবস্থা আর আসেনি। এই অস্থিরতার হাওয়া লেগেছে আফ্রিকা-এশিয়া, ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর সবখানে। ভূস্বর্গ হিসেবে খ্যাত কাশ্মীরও সেই অস্থিরতা থেকে বাদ পড়ছে না। কাশ্মীরে কয়েকদিন ধরে চলমান সংকট ও সংঘর্ষ যেন সেই অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ। তবে কাশ্মীর সংকটের শেকড় আরো অনেক গভীরে প্রোথিত। ক্ষণে ক্ষণে বের হয়ে আসে সেই সংকট নামক আগ্নেয়গিরির লাভা।
কাশ্মীরিদের কাছে ‘পোস্টার বয়’ হয়ে ওঠা বুরহান মুজাফফর ওয়ানির হত্যা ও তাঁর দাফনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠে কাশ্মীর উপত্যকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে উত্তেজিত জনতার মধ্যে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ২৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুইশরও বেশি মানুষ। সেই সংঘাত থেকে বাদ পড়ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। উত্তেজিত জনতা এক পুলিশ সদস্যকে বহনকারী গাড়িসহ খরস্রোতা ঝিলম নদীতে ফেলে দেয়। চারটি পুলিশ স্টেশন, ৩৬টি বেসামরিক প্রশসানিক অফিস ও প্রায় ডজন খানেক যানবাহনে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অধিক পরিমাণে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করেছে। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বলবৎ ছিল।
গত শুক্রবার দক্ষিণ কাশ্মীরের কোকরনাগ এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে দুই সঙ্গীসহ হিজবুল মুজাহেদীনের স্বঘোষিত কমান্ডার বুরহান ওয়ানি নিহত হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্যমতে তিনি একজন ‘জঙ্গি’ এবং যুব সমাজকে বিপথগামী করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী। ফেসবুকসহ অনলাইন মিডিয়াতে তাঁর প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে। কিন্তু ‘স্বাধীনতাকামীদের’ কাছে তিনি ‘হিরো’। বছর দুয়েক ধরে ওয়ানি কাশ্মীরি ‘স্বাধীনতাকামীদের’ কাছে ‘আইকন’ হয়ে উঠেছেন। তাঁর মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি ‘স্বাধীনতাকামীরা’। ফলে তাঁর জানাজাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। আর তাতে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ ।
এই ঘটনাসহ শুধু ২০১৬ সালেই কাশ্মীর উপত্যকায় কমপক্ষে চতুর্থবারের মতো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরো কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনাও ঘটে। আইনশঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে স্বাধীনতাকামীদের সংঘর্ষ, স্বাধীনতাকমী কর্তৃক বিএসএফ ও সেনাবাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ২৫ জুন ‘স্বাধীনতাকমীদের’ হামলায় পাঁচজন ভারতীয় সেনা নিহত হন। তার আগে ৫ জুন ‘স্বাধীনতাকমীদের’ হামলায় তিন বিএসএফ জওয়ান নিহত হন। এই ঘটনা হিজবুল মুজাহেদীন দায় স্বীকার করে। এ ছাড়া ১২ এপ্রিল ভারতীয় সেনা কর্তৃক এক কাশ্মীরি ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। সেই ঘটনায় পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরের স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সংগঠন স্বশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসছে। এসব সংগঠনের মধ্যে অন্যতম হলো হিজবুল মুজাহেদীন।
‘স্বাধীনতাকামীদের’ সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে সেখানে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান ভাগের আগে কাশ্মীর ‘দেশীয় রাজ্য’ হিসেবে ছিল। ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী, দেশীয় রাজ্যগুলো চাইলে ভারতে কিংবা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারত। অথবা তারা একটি কমিশন গঠন করে আলাদা রাষ্ট্রও গঠন করার সুযোগ ছিল। এ ক্ষেত্রে দেশীয় রাজ্যগুলোর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। দেশ বিভাগকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভারত ডোমিনিয়নে যোগদান করে। অন্যদিকে পাকিস্তান তার সেনাবাহিনী দিয়ে কাশ্মীরের কিছু অংশ দখল করে নেয়। তখন থেকেই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান। আর যারা স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্ন দেখেছে তাদের লড়াইও শুরু হয় তখন থেকেই।
কাশ্মীর সংকটের পেছনে অনেক কারণ জড়িত। সবচেয়ে বেশি দায়ী ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’। কাশ্মীরে ভারতের সম্প্রসারণবাদ নীতি, পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ও ভারত-পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী কিছু সুবিধাভোগী মানুষের কারণে কাশ্মীর সংকটের অবসান হচ্ছে না। এ ছাড়া ভারত-পাকিস্তান পরস্পর-পরস্পরকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছাড় না দেওয়াটাও কাশ্মীর সংকটের জন্য দায়ী।
কাশ্মীরের রাজনৈতিক সংকট প্রধানত দুটি দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. আঞ্চলিক রাজনীতি। দুই. ভারতের জাতীয় রাজনীতি।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে অন্যতম প্রধান কারণ এই কাশ্মীর। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব পড়ে উপমহাদেশজুড়ে। ঐতিাহাসিক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ক্রিড়নক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
আঞ্চলিক রাজনীতিতে কাশ্মীর সংকট আরো একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের দাবি অনুযায়ী সত্যিই যদি সেখানে স্বাধীনতাকামীরা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হয় তাহলে তা এই অঞ্চলের জন্যও হুমকি। কাশ্মীরের জঙ্গিদের প্রভাব ভারতসহ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
আর ভারতের জাতীয় রাজনীতির দিকে থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরে বিদ্যমান ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বা ‘স্বাধীনতাকামী’ আন্দোলন বাড়তে থাকলে এবং যদি তা সফল হয় তাহলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও তার প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে আসামের মতো রাজ্য, যেখানে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ ইতিমধ্যেই স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরের ‘স্বাধীনতাকামী’ আন্দোলন অন্যান্য প্রদেশে স্বাধীনচেতাদের উৎসাহিত করবে।
ফলে ভারতে জন্য কাশ্মীর দুটো সংকট তৈরি করে। এক. পাকিস্তানের সাথে দ্বন্দ্ব। দুই. স্বাধীনতাকমী কাশ্মীরি ও পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্তিতে বিশ্বাসী কাশ্মীরিদের সাথে দ্বন্দ্ব। কিছুদিন পর পরই বিশেষ কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীর অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়। স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠে। অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন উঠে। আর রাষ্ট্রপক্ষ স্বাধীনতাকমীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা জঙ্গির মোড়কে উপস্থাপন করে তাদের কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাকাঠামো কাশ্মীরি জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর যেটি ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ প্রদেশ নামে পরিচিত তার মূলত তিনটি অংশ। জম্মু, লাদাখ ও কাশ্মীর উপত্যকা। জম্মু অঞ্চলে অধিক মন্দির থাকায় এটি হিন্দুদের কাছে তীর্থ স্থান। লাদাখ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্যদিকে কাশ্মীর উপত্যকা ৯৮ শতাংশ মুসলিম উধ্যুষিত এলাকা। জম্মু ও লাদাখের রাজনীতিকরা ভারতের অধিক কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। কিন্তু সুবিধাভোগী শ্রেণি ছাড়া কাশ্মীরের বেশির ভাগ জনগণই স্বাধীনতার পক্ষে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের প্রধান দুটি বিবেচ্য বিষয় হলো—এক. কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতা দুই. কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তকরণ। দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানিদের প্রধান যুক্তি হলো ১৯৪৭ সালের ভারত পাকিস্তান বিভক্তির ‘দ্বিজাতি’তত্ত্ব। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়ে থাকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে কাশ্মীরকে পাকিস্তানেই যোগ দেওয়ার কথা। যার কারণে তারা সেখানকার কিছু ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিককালে কাশ্মীরের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির চেয়ে স্বাধীনতাকামী আন্দোলনই অধিক জোরদার হয়ে উঠেছে। একটি জরিপে দেখা গেছে ৪৩ শতাংশেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক কাশ্মীরি স্বাধীনতার পক্ষে। ১৯৪৭ সালের গোলযোগের পরে নেহরু কাশ্মীর ইস্যুতে গণভোট আয়োজনের কথা বলেন। কিন্তু দীর্ঘ ৭ দশক অতিবাহিত হলেও ভারতীয় সরকার গণভোটের আয়োজন করেনি।
সাম্প্রতিককালে কাশ্মীর সংকটের মূলে রয়েছে নয়াদিল্লির কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান। নয়াদিল্লির কাশ্মীরনীতি হলো রাজ্যটির ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা এবং এর স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেয়। কিন্তু নয়াদিল্লির কর্তৃত্ববাদী নীতি কাশ্মীরি জনগণকে দিন দিন ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে। এবারের টি২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে ভারতের বিদায়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কাশ্মীরি ছাত্রকে আনন্দ মিছিল করতে দেখা গেছে। এর বহু আগে ১৯৮৩ সালে শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচে ভারত পরাজিত হলে সেখানেও কাশ্মীরিরা উল্লাস প্রকাশ করে। এসব ঘটনায় কাশ্মীরি জনগণের ভারত বিদ্বেষী মনোভাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি স্বাধীনতাকামী সংগঠন। এই সংগঠনগুলোর কোনো কোনোটি সশস্ত্র। যাদের ভারত সরকার কখনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, কখনো ‘জঙ্গি’ আবার কখনো ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘স্বাধীনতাকামীদের’ কাছে যে বা যারা ‘নায়ক’ সম্প্রসারণবাদীদের কাছে তারাই জঙ্গি বা সন্ত্রাসী। কাশ্মীরে ওয়ানিকে কেন্দ্র করে চলমান ঘটনায় এটা অন্তত স্পষ্ট যে, যাদের ভারত সরকার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ কিংবা ‘জঙ্গি’ অপবাদ দিচ্ছে সেখানকার জনগণের কাছে তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
ফলে চলমান সংকট যার যাত্রা শুরু ভারত-পাকিস্তান কর্তৃক কাশ্মীরকে জোরপূর্বক দখলের মধ্য দিয়ে তার সমাধান কেবল সমঝোতার মাধ্যমেই সম্ভব। কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক বা নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা দিয়ে এর সমাধান সম্ভব নয়। কাশ্মীরি জনগণকে তাদের অধিকার চর্চা করা থেকে বিরত রাখলে তা তাদের ক্রমান্বয়ে আরো উগ্রপন্থায় রূপান্তর করবে। জনগণের ওপর জবরদস্তিমূলকভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে। অপশাসন, নির্যাতন আর শোষণের বিরুদ্ধে যে আগুন জ্বলছে তা নিভবে না কোনোদিন। সহিংসতা বাড়বে বৈ কমবে না। সেই সহিংসতা ভূস্বর্গকে ধীরে ধীরে নরকে পরিণত করবে। ফলে সুষ্ঠু সমধানের প্রথম পদক্ষেপই হলো অধিক পরিমাণে কেন্দ্রীভূত শাসনের পরিবর্তে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
লেখক : গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক