ফ্রান্স ট্র্যাজেডি
রক্তে মলিন উৎসবের রং!
গত বছরের নভেম্বরে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর জারি হওয়া জরুরি অবস্থা এ মাসের শেষের দিকে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা শেষ না করে বরং বাড়াতে হলো। আবারও ফ্রান্সে সন্ত্রাসীদের আঘাত! একটা শোক কাটিতে না উঠতেই আবারও ৮৪ জনের লাশের বোঝা বইতে হচ্ছে ফ্রান্সকে! সন্ত্রাসীদের এ হামলায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আরো অনেকে। হাসপাতাল সূত্রগুলো বলছে, আহত দুই শতাধিক মানুষের মধ্যে ৫০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরিস্থিতি ভালো না। এ উপলক্ষ্যে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মানুয়েল ভালস তিনদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান ছিল ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’। এ স্লোগানে ফ্রান্সের মানুষ শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্সে নয়, মুক্তির পথ দেখায় পুরো ইউরোপে। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বাস্তিল দুর্গ পতনের এ দিনে সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’ স্লোগানের ওপর মারা হলো পেরেক!
ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নিসে রাত তখন ১১টার মতো। বাস্তিল দুর্গ পতনের দিবসে সরকারি ছুটি। দিবসটি উপলক্ষে সমুদ্রতীরে আয়োজন করা হয় আতশবাজির প্রদর্শনী। আর সেটা দেখতে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ।
কিছুক্ষণ আগেই তারা বিমানবাহিনীর একটি জমকালো অনুষ্ঠানও উপভোগ করে। শহরের একটি বিখ্যাত সড়ক। সমুদ্রের পাড়েই লম্বা সেই রাস্তা। সেখানে নেমে এসেছে বহু পরিবারের ঢল। হঠাৎ করেই ওই রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসে সাদা রঙের একটি লরি এবং ভিড়ের ভেতর দিয়ে একেঁবেঁকে চলতে থাকে। আতঙ্কে লোকজন ছুটতে শুরু করে চারদিকে। লোকজনের ওপর দিয়ে ট্রাকটি ছুটে চলে দুই কিলোমিটার পথ। তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক মুসলিম মোহামেদ ল্যউইজ বুলেল এই হামলা চালান। তিনি একপর্যায়ে লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করেন। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে চালক নিহত হন। লরিটির সামনের অংশ বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ভেতর থেকে পুলিশ বন্দুক ও গ্রেনেড উদ্ধার করে। নিহতের সংখ্যা যত সম্ভব বাড়াতেই লরিটিকে এভাবে একেঁবেঁকে চালানো হয়। শেষপর্যন্ত পুলিশ ট্রাকটিকে থামাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ততক্ষণে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আহত হয় আরো বহু মানুষ। তাদের অনেকের অবস্থা গুরুতর। হতাহতদের অনেকেই নারী ও শিশু।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ফ্রান্সের ব্যঙ্গচিত্র সাময়িকী শার্লি এবদোতে হামলার স্মৃতি এখনো তাজা। এরপর নভেম্বরে আবার হামলা হয় রাজধানী প্যারিসে। এখন আবার সর্বশেষ নিস শহরে দেশের জাতীয় দিবসে হামলায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বারবার কেন হামলার শিকার হচ্ছে ফ্রান্স? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে এ ধরনের হামলার যে কটি কারণ পাওয়া যায়, তাতে চলমান বিশ্বে আইএসের জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে এর যে একটা যোগসূত্র আছে, সেটা বেশ স্পষ্ট। তবে হামলার ধরনটি বেশ অভিনব! ট্রাকে পিষে মানুষ মারা! এর আগে এ ধরনের হামলা না হলেও ২০১০ সালেই ট্রাককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা। ইয়েমেন আল-কায়েদা পশ্চিমে বসবাসকারী তাদের অনুসারীদের এই পরামর্শ দিয়েছিল। এরপর ২০১৪ সালে আইএসের একজন মুখপাত্রও তাদের অনুসারীদের একই ধরনের পরার্মশ দেন। এসব থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চত হওয়া যায় এ ঘটনা কে বা কারা ঘটিয়েছে।
বেশ কয়েকটি কারণে আইএসের জন্য বর্তমানে এক নম্বর টার্গেটও ফ্রান্স। একটি কারণ ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিমান হামলা। যেখানে ফরাসি জঙ্গি বিমান অংশ নেয়। মালি, ইরাক এবং সিরিয়ায় জিহাদিদের হটাতে সক্রিয় ভূমিকা আছে ফ্রান্সের। সাম্প্রতিক সময়ে ১০ হাজারের বেশি ফরাসি সেনা বিদেশে মোতায়েন আছে। তিন হাজার সেনা আছে পশ্চিম আফ্রিকায়, মধ্য আফ্রিকায় আছে দুই হাজার সেনা, তিন হাজার ২০০ সেনা আছে ইরাকে। উদার ও মুক্তচিন্তা, খোলামেলা পরিবেশ, শিল্প, সাহিত্যের আধার ফ্রান্সকে আইএস কখনই মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। গতবছর প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করার সময় আইএস ফ্রান্সের এ শহরটিকে ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ড আর পতিতাবৃত্তির রাজধানী’ আখ্যা দেয়। ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যাও আছে। বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাকে দেখা হয় ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা হিসেবে। জেলখানার বন্দিরাও উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকছে। ফরাসি কারাগারগুলোতে এই ঘটনা প্রচুর ঘটছে। ছোটখাটো অপরাধের জন্য লোকেরা সেখানে যায়; কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে কট্টর জিহাদি হিসেবে।
বেশ অল্প দিনের ব্যবধানে বড় বড় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলো ফ্রান্স। বাস্তিল দুর্গ পতনের দিনে এ ঘটনায় শোকে নিমজ্জিত ও হতবিহ্বল পুরো জাতি। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ এ ঘটনার পর সেখানে ছুটে যান। এ ব্যাপারে করণীয় নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববাসী শোকে মুহ্যমান। হামলার নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ১৯ জুলাই পর্যন্ত তাঁর দেশের সরকারি ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনার পাশাপাশি ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’ রোধে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে পুতিন, মের্কেলের মতো বিশ্বনেতারা। আমাদের দেশে তো বটেই, পুরো পৃথিবীতে এখন ঐক্যের কোনো বিকল্প নাই। প্রশ্ন হচ্ছে তাতেও কোনো লাভ হবে কি না? যেভাবে হামলা চালানো হচ্ছে, তাতে বিশ্ববাসী কেউই আজ নিরাপদ নয়। আমাদের দেশে হামলা চালানো হলে; বলা হয়, আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার নয়। এটা-ওটা আরো অনেক কিছু; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ফ্রান্সের মতো দেশে তো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা থাকার কথা নয়? তার পরও বিগত আঠার মাসে ফ্রান্সে ছোট-বড় সাতটি সন্ত্রাসী হামলা হলো। সব মিলিয়ে এসব হামলায় প্রাণ হারায় ২৩০ জন। এর মধ্যে গত নভেম্বরের এক হামলায় মারা যায় ১৩০ জন।
লেখক : সাংবাদিক