ফ্রান্স ট্র্যাজেডি
ফ্রান্সে ট্রাক-সন্ত্রাসের কারণ কী?
বিশ্বব্যাপী হামলা-হত্যার ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে জঙ্গি হামলার পরিমাণ। গত বছরের ১৪ নভেম্বরে প্যারিসে আইএস জঙ্গিদের হামলায় ১৩০ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর এবার অভিনব এই ট্রাক-সন্ত্রাসে বিশ্ববাসী নির্বাক প্রায়। ট্রাক-সন্ত্রাসের নজির ইতিপূর্বে কখনো হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে এমন প্রশ্নটি সামনে আসা স্বাভাবিক যে, ফ্রান্সের ঘটনার পর একই কায়দায় অথবা অন্য কোনো অভিনব কায়দার সন্ত্রাসী হামলা আরো কি দেখতে হবে? আর কোন রাষ্ট্রের জন্যই বা অপক্ষো করছে নতুন কোনো হামলা! বাস্তিল দিবস (স্বাধীনতা দিবস) উদযাপনকালে হাজার হাজার মানুষের ওপর এমন বর্বোরিচিত ট্রাক-হামলার ঘটনায় বিশ্ববাসীকে কাঁদতে হয়েছে। আট মাস আগের জঙ্গি হামলার পর থেকে দেশে যে জরুরি অবস্থা ছিল তা এ মাসেই হয়তো শেষ হতো। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস আরো তিন মাস ফ্রান্সবাসী জরুরি অবস্থার কবলে পড়তে বাধ্য হলো। ফ্রান্সে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে যখন অধিক নিরাপত্তার নজর বিদ্যমান রয়েছে ঠিক সে সময়ে এমন অভিনব সন্ত্রাসী হামলা বিশ্ব সন্ত্রাসকে রীতিমত উসকে দেওয়ার শামিল হয়েছে।
কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী প্রাথমিকভাবে ফ্রান্সের হামলার দায় স্বীকার না করলেও আইএস এই হামলাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। ফ্রান্সের এই হামলাকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসের নতুন মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জঙ্গি সমস্যা নিয়ে যখন চিন্তিত তখন এই ঘটনায় বিশ্ব নেতাদের জঙ্গি দমন তথা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নতুন কৌশলের সূত্রপাত ঘটাবে। গত কয়েক মাসে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি হামলাতেই যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। এমনকি বাংলাদেশেও সম্প্রতি গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদাগাহ মাঠে ঈদের নামাজের সময় জঙ্গি হামলার ঘটনাও এক নতুন মাত্রার হামলা। পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যাচ্ছে যে, বর্তমানে বিশ্বের কোনো প্রান্তই জঙ্গি হামলার আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়। বিশেষ করে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম কিংবা তুরস্কে জঙ্গি হামলার পর এ বিষয়ে আর কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। এখন ইউরোপ, আমেরিকা শুধু নয়, বিশ্বেও কোনো দেশই বোধ হয় জঙ্গি টার্গেটের বাইরে নেই। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে আক্রমণ করলেও প্রকৃত পক্ষে তাদের একটাই পরিচয় অর্থাৎ কখনো তালেবান, কখনো আল-কায়েদা কিংবা কখনো আইএস। মূলত তারা এক।
মুক্তচিন্তার দেশ হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সে ঘনঘন সন্ত্রাসী হামলার কারণ কী তা নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। অল্প সময়ে কয়েকবার হামলার ঘটনায় ফ্রান্স রাষ্ট্রটি এখন জনগণের ক্ষোভের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যে রাষ্ট্রে মানুষ শান্তির খোঁজে আশ্রয় নিতে চাইতো, সেই রাষ্ট্রে এমন সন্ত্রাসী হামলার পুনরাবৃত্তি বিশ্ববাসীর গলার কাঁটার শামিল হিসেবেই বিবেচেনা করার সময় এসেছে। ফ্রান্সে চলমান জনক্ষোভের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ৯/১১-র সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। ২০০১ সালে নিউইয়র্কে হামলার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে আমেরিকা। সঙ্গে ছিল ব্রিটেন। ফ্রান্স সেই সময়ে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছিল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাতারে ফ্রান্স নিজেকে শামিল করতে পারেনি যথাযথভাবে। বলা যায় সন্ত্রাসবিরোধী জোটের পাশে সেভাবে দাঁড়ায়নি ফ্রান্স। ফলে এই মুহূর্তে আমেরিকা ফ্রান্সের পাশে থাকবে কি না কিংবা ফ্রান্সের সে ধরনের আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহ আছে কি না সেটি এখন আন্তর্জাতিক মহলের নতুন ভাবনা। ইরাক অভিযান নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ফ্রান্সের তীব্র মতপার্থক্য ছিল। এর পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সম্পর্কের মাত্রায় পরিবর্তন এসেছে কতটুকু? আদৌ কী পরিবর্তন এসেছে? না কি আদৌ পরিবর্তন সম্ভব?
আমেরিকা ৯/১১ হামলার পর থেকে জঙ্গি সম্পর্কে অনেক সচেতন। যতটা সচেতন বিশ্বে অন্য কোনো রাষ্ট্র আজো হতে পারেনি। যেমন বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে জঙ্গি অপতৎপরতার বিষয়টি সামনে এলেও প্রকৃত অর্থে জঙ্গি দমনে যেসব পদক্ষেপ ইতিপূর্বে নেওয়া হয়েছে তার বেশির ভাগই কাগজে-কলমে। কিন্তু আমেরিকা জঙ্গি দমনে দীর্ঘ সময় থেকেই সফলতার ঝুড়ি ভারি করতে শুরু করেছে। তবে সেই মাত্রায় ফ্রান্স অনেক পেছনে পড়ে আছে। গত দেড় বছরে পরপর তিনটি হামলা হলেও তাদের সন্ত্রাস মোকাবেলার ইস্যুটি অনেকটা কাগজে-কলমে। এ কারণে এখন সবার ধারণা ফ্রান্স ও বেলজিয়াম তথাকথিত জিহাদিদের উর্বরক্ষেত্রে পরিণত হতে চলেছে।
ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ৭.৫ শতাংশ মুসলিম। উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে অনেকই ফ্রান্সকে পছন্দ করে নিয়েছে। অনেকদিন থেকেই এই প্রয়াসটি শান্তিকামী মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যেত। কিন্তু ১৮ মাসের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের হামলার ফলে শান্তি খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রটি কি আর পুনরায় খুঁজে পাওয়া যাবে? কোনো এক অজানা বা জানা কারণে দেশটির ওপর জঙ্গিদের আক্রোশ খুব বেশি মনে হয়েছে। দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকা ব্রিটেন বা আরো কয়েকটি দেশের মতো প্রকাশ্য কোনো বৈরিতা লক্ষ করা যায় না। তারপরও এ দেশের জনগণের ওপর এমন বর্বরোচিত হামলার মানে কী? তাহলে কি তারা মানবাধিকারের প্রশ্নে মানুষ এনে আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছিল?
সুনির্দিষ্টভাবে কিছু কারণে হয়তো ফ্রান্স জঙ্গিদের টার্গেটভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। ২০১৪ সালে আইএসের আবির্ভাব পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এই প্রথম শুধু জিহাদি হামলা নয়, খলিফাতন্ত্রেও প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো শুরু হয়েছে। সেই আকর্ষণে ফ্রান্স থেকে সিরিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। ইউরোপ থেকে প্রায় ছয় হাজার জিহাদি সিরিয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ ফ্রান্স থেকে। প্যারিস, ব্রাসেলস বা নিসে যে ধরনের হামলা হয়েছে, স্থানীয় স্তরে সমর্থন না থাকলে এ ধরনের হামলা চালানো সম্ভব নয়। নভেম্বরে প্যারিস হামলার অন্যতম চক্রী সালাহ আবদেলসালামকে ধরতেই প্রায় ছয় মাস লেগে গেছে। ব্রাসেলসের যে আস্তানা থেকে তাঁকে ধরা হয়েছিল, তার কয়েকটি বাড়ি পরেই আবদেলসালামের মূল বাড়ি। স্থানীয় সমর্থন না থাকলে গোয়েন্দাদের এত সক্রিয়তা সত্ত্বেও এভাবে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তৃণমূল স্তরের সঙ্গে ফ্রান্সের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর এই বিচ্ছিন্নতা হামলার সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা।
গত বছর সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকারের সময় ফ্রান্সের এ শহরটিকে ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ড আর পতিতাবৃত্তির রাজধানী’ আখ্যা দেয়। এ ছাড়া ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ কিছু গলোযোগ তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মূলত এসব অভিন্ন কারণকে জঙ্গি হামলার অন্যতম ইস্যু হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। তবে এখন ভাবনার সময় এসছে ফ্রান্সের ধাবমান ট্রাক-সন্ত্রাস যেন বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রে ঢুকে না পড়ে। কারণ পৃথিবীতে বহু ঘটনা আছে যেগুলো ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে অপরাধীদের উসকে দেয়। উল্লেখ্য, ভারতে এক সময় চলন্ত বাসে এক নারী ধর্ষণের স্বীকার হলে তা গণমাধ্যমে প্রচারের পর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। অথচ এমন ঘটনা ওই সময়ে ভারতেই প্রথম চোখে পড়ে। আবার বাংলাদেশে শিশু হত্যার মতো বর্বরতা এবং এর শাস্তির খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হলেও এমন ভয়াবহতার বহু পুনারবৃত্তি ঘটেছে। ঠিক তেমনটি বহু সন্ত্রাসী হামলা অন্য অনেক সন্ত্রাসী হামলাকে উসকে দিয়েছে। কাজেই এখন সময় এসেছে সচেতন হওয়ার। জঙ্গিবাদকে দমন করে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাকে সোচ্চার কণ্ঠ তুলতে হবে।
নিস শহরে ফরাসি বিপ্লবের আলোকসজ্জা দেখতে যাওয়া মানুষগুলোর কোনো অপরাধ ছিল না। এমন আলোকসজ্জা বহু দেশে হয়। বিশ্ববাসীর প্রত্যেকেই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই এর বাইরে নয়। প্রতিটি দেশেই আলোকসজ্জার সংস্কৃতি রয়েছে। তাহলে সন্ত্রাসীরা কি আলোকসজ্জা বন্ধ করতে চায়? সংস্কৃতি চর্চা মানতে কি চায় না? বিশ্বনেতাদের এমন সব উত্তর খুঁজে বের করার সময় এসেছে। চিন্তা নয়, প্রশ্ন নয় সমাধানই এখন একমাত্র পদক্ষেপ হওয়া উচিত।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।