আন্তর্জাতিক
তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রের লড়াই
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর রাস্তায় নেমে এসেছিল তুরস্কের সরকার সমর্থকরা। আঙ্কারা-ইস্তাম্বুলের মতো প্রধান শহরগুলোতে জাতীয় পতাকা হাতে সরকারের প্রতি নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। গণতন্ত্রকে কোনোভাবেই সামরিক আঘাতে কাবু করা যাবে না, এমনটাই তাদের স্লোগান। আবারও বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকতে পারে, এমন শঙ্কাও রয়েছে তাদের। যদিও এখনো পরিষ্কার না, কে বা কারা তুর্কি অভ্যুত্থানের চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত, তবুও প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অভ্যুত্থানচেষ্টার ষড়যন্ত্রের জন্য নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ওই নেতাকে তুরস্কের কাছে প্রত্যর্পণ করতে মার্কিন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান এরদোয়ান। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট বলেন, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে অনেক আগে থেকেই তারা তার সরকারকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছিল। এমনকি তিনি বলেন, পাঁচ দশক ধরে সেনাবাহিনীর হাতে যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁদের কারো অংশ থাকতে পারে এ অভ্যুত্থানের পেছনে।
অবশ্য তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থানকে দেখা হচ্ছে প্রেসিডেন্টের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। মূলত দেশটির জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকেই এমন প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করছে। ২০১৫ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা আরো সংহত হয় দলটির। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেতে সংবিধান সংশোধনেরও চেষ্টা করেন এরদোয়ান।
সম্প্রতি নানা কারণে দেশটিতে বেড়েছে সহিংসতা। ভেঙে গেছে কুর্দিদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের শান্তিচুক্তি। নিয়মিতই চলছে হামলা-পাল্টাহামলা। এসব হামলায় আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষসহ সেনাসদস্যরা। সহিংস পরিস্থিতির জন্য সরকারের আগ্রাসী নীতিকে দায়ী করছে তুর্কি জনগণ। অনবরত বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলা দেশটিকে কাতর করে দিয়েছে। কুর্দি বিদ্রোহীদের পাশাপাশি হামলা চালাচ্ছে আইএসও। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সিরিয়ায় আইএসের অবস্থানে বিমান হামলা শুরুর পরই বাড়ে এসব হামলার তীব্রতা। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের আইএস-সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তনের কারণে ঘটেছে, তা দেখার বিষয়। ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সিরিয়াবিরোধী লড়াইয়ের শুরুর দিকে মদদ দিয়েছিল তুরস্ক। আইএসে যোগ দিতে যাওয়া সন্ত্রাসীদের বড় অংশ তুরস্ক হয়েই সিরিয়ায় পৌঁছায়। তুরস্কে গোপনে এখনো আইএস জঙ্গিদের অনেক ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসীদের আত্মঘাতী বোমা হামলার পর তুরস্ক আইএস জঙ্গিদের মদদ দেওয়ার ভূমিকা থেকে সরে আসে। তুরস্কের এ অবস্থান পরিবর্তন আইএস জঙ্গিদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ক্ষোভের কারণ হতে পারে। সেই ক্ষুব্ধ আইএস মদদদাতারা সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি অংশকে ব্যবহার করে সেনা অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতি আমাদের একটি প্রবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়—‘নগর পুড়িলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না’। বর্তমানে সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত বিশ্বে সবাই অনিরাপদ। বিশ্বনেতারা যখন জঙ্গি হামলাসহ নানা সন্ত্রাসী হামলায় শঙ্কিত, ঠিক তখনই তুরস্কে ব্যর্থ সেনা বিদ্রোহে মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান সন্ত্রাসের বিস্তৃতির সুযোগ তৈরি হতে পারে। এই ব্যর্থ সেনা বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়ে আইএসবিরোধী দেশগুলোর সতর্ক থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
তুর্কি অভ্যুত্থানের চক্রান্তের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত ছিল, তা পরিষ্কার না হলেও এ বিষয়টি পরিষ্কার যে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টি সরকার এবং দেশের সরকারকে উৎখাত করাই ছিল এই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। তবে এ চেষ্টার পর একটি বিষয় নিশ্চিত হয়েছে যে তুরস্কের গণতান্ত্রিক কাঠামো আরো ভঙ্গুর হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে যদি সামরিক জান্তারা জয়ী হতো, তাহলেও শাসনব্যবস্থা অধিকতর নাজুক হয়ে পড়ত। বলা যায়, ক্ষমতা চলে যেত জেনারেলদের নিপীড়নে। জেনারেলদের হাতে গেলেও শাসনব্যবস্থার উৎকর্ষের আশা করাটাও বোকামি ছাড়া কিছু না। তবে সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় তুরস্কের চলমান নিপীড়িত রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা আরো কঠিন হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।
২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এরদোয়ান শাসনব্যবস্থাকে ক্রমে স্বৈরাচারী করে তুলেছে। দেশ চালানো হয়েছে নানাবিধ ভিন্নমতের মধ্য দিয়ে। সমাবেশ, সংগঠন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমশ অবনতি ঘটেছে। প্রাথমিকভাবে একটি সংস্কারবাদী হিসেবে অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং সে ভিত্তিতে ২০০৭ ও ২০১১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হলেও পরবর্তীকালে এরদোয়ান একজন রক্ষণশীল ও স্বৈরাচারী শাসকে রূপ নিয়েছে, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ভঙ্গুর করে তুলেছে।
যদিও এরদোয়ানের নির্বাচনী সাফল্যের পেছনে অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার ইতিবাচক দিক আংশিক কাজ করেছে, কিন্তু এর পেছনে কতিপয় নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজিত ছিল। নানা অপকৌশলেও তিনি নির্বাচনী ফলাফলকে নিজের অনুকূলে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বামপন্থী, উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ, সামাজিক গণতন্ত্রী, উদার-অনুদার মুসলমান ও কুর্দি জনসংখ্যার ওপর বলপ্রয়োগে নির্বাচনী বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। এটি এখন সবাই ধারণা করতে পারছে যে এরদোয়ানের স্বৈরাচারী আচরণের ফলে শাসনব্যবস্থায় ফাটল এবং ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত হয়।
সরকার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঠিক করেছিল, রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের, যারা সম্মিলিতভাবে দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ২০১১ ও ২০১৫ সালের নির্বাচনে একে পার্টির ভোটের ৪৯.৫ শতাংশ পেয়ে জয়লাভ করেছিল। কীভাবে পেয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর ভিন্ন। এর আগে সেনাবাহিনীর সরকারবিরোধী একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার অভিযোগ এনে ২০০৮ সালে এরদোয়ান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে একটি খড়্গ আরোপ করে। ওই সময়ে জেনারেলদের একটি অংশকে জেলেও পাঠানো হয়। এমনকি সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিরোধীদের, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ, পণ্ডিত এবং সাংবাদিকসহ অনেকেই সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
তবে তুরস্কে যে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে, তা গণতন্ত্রের জন্য খারাপ। এ ক্ষেত্রে অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীদের হয়তো সরিয়ে দেওয়া যাবে কিংবা শাস্তির আওতায় আনা যাবে; কিন্তু অন্য সব ভিন্নমতধারী ও বিরোধীবাদীদের কি শাস্তির আওতায় আনা যাবে? তবে তাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে এমনটি আশা করাই শ্রেয় যে, ভবিষ্যতে অনেককেই নিপীড়ন মেনে চলতে হবে। গণতান্ত্রিকভাবে বিরোধিতার ক্ষেত্রটি কেমন হবে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে আগামীতে কিছু সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) ও অনুরূপ সংগঠনগুলোর চরমপন্থীগোষ্ঠীদের কার্যকলাপ দ্বারা।
কাজেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানকে খালি চোখে ব্যর্থ মনে করে বসে থাকলে হবে না। গণতন্ত্রের যে স্লোগান তুরস্কের সরকার সমর্থকরা রাজপথে দিতে শুরু করেছে, তা ধরে রাখতে সরকারকেও যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে। তুরস্কের এই অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের গণতন্ত্রবাদী নেতাদের আরো সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। গণতন্ত্র রক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার প্রত্যয় নিয়ে বিশ্বের সকল গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্রকে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব রাজনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজতে হবে। তুরস্কে সরকারকেও দ্রুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে গণতন্ত্র সুসংসহত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।