আন্তর্জাতিক
ট্যাঙ্কের ওপর গণতন্ত্রের জয়গান
তুরস্কে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে একদল সেনাসদস্য। অল্প সময়ের ব্যবধানে জনতার মিছিলে অভ্যুত্থানকারীদের পরাজয়ও ঘটে। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর সেখানকার সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দল সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থানের জানান দেয়। ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অভ্যুত্থান খুব কমই পাওয়া যায়। আর এই সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া, তার নজিরও পৃথিবীতে বিরল। তাই তুরস্কের এই অভ্যুত্থান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতি-বিশ্লেষক সবাইকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। ফলে বিষয়টি সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের দিকে থেকে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এখানে কয়েকটি বিষয় আলাদা করে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি—১. সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক দিক ও তুরস্কের এই সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা; ২. বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভ্যুত্থান, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মিসরের সঙ্গে এই অভ্যুত্থানের একটি তুলনা; ৩. সামরিক শাসনের কিংবা সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য; ৪. অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের আহ্বান ও জনগণের প্রতিক্রিয়া।
সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের মূলনীতিই হলো সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বশীল বেসামরিক সরকারের অধীনে থেকে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করবে। আর সামরিক পেশাদারিত্বের দাবিও তাই। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করবে, এটাই কাম্য। আধুনিককালে প্রায় সব তাত্ত্বিকই একমত যে, সেনাবাহিনীকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে থাকতে হবে। এতে একদিকে যেমন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে, তেমনি অটুট থাকবে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব। মাও সেতুং বলেছেন, ‘রাজনীতিই সকল কিছু নিয়ন্ত্রক।’ তিনি বলেছিলেন, ‘পার্টি বন্দুক নিয়ন্ত্রণ করবে এবং বন্দুক কখনোই পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।’
তুরস্কের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল কিংবা সেনা অভ্যুত্থান নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে সামরিক বাহিনী বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে। সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে রাজনীতির মঞ্চে আসীন হয়েছে। তুরস্কে ১৯২০ সালের পর এ পর্যন্ত চারবার (১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ ও ১৯৯৭) সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। আর সেনা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র হয়েছে বহুবার। কিন্তু ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত করার পর প্রায় ১৯ বছর কেটে গেছে। ধারণা করা হচ্ছিল, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই সেনাবাহিনী হয়তো আর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু হঠাৎ সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানচেষ্টা রাজনীতি-বিশ্লেষকদের নতুন করে ভাবাচ্ছে।
আধুনিককালে অনেক শাসককেই দেখা গেছে, তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকারের প্রতি অনুগত করে রাখে। তুরস্কেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেনাবাহিনীর মূল কাজ প্রতিরক্ষা হলেও তারা তাদের ‘করপোরেট ইন্টারেস্ট’ দ্বারা চালিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা গেছে, যখনই সেনাবাহিনী দেখে তাদের ‘করপোরেট ইন্টারেস্ট’ ব্যাহত হতে চলছে, তখনই তারা কলকাঠি নাড়া শুরু করে। কখনো কখনো সরাসরি ক্ষমতার মসনদ দখল করে নেয়। আর যে সরকার তাদের ‘করপোরেট ইন্টারেস্ট’ রক্ষা করতে পারে, তারা সেই সরকারের প্রতি বেশি অনুগত থাকে।
সাধারণ কয়েকটি কারণে সেনা অভ্যুত্থান হয়ে থাকে, যেমন—সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক সুপিরিওরিটি, ‘মিলিটারি করপোরেট ইন্টারেস্ট’, সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, দুর্বল-দুর্নীতিগ্রস্ত ও জনসমর্থনহীন বেসামরিক সরকার, বিশৃঙ্খল ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিক পরিস্থিতি। সেনাবাহিনীকে তুরস্কের সরকার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। ফলে এখানে ‘করপোরেট ইন্টারেস্ট’ ব্যাহত হওয়ার কারণে অভ্যুত্থান হয়েছে, তা বলা যাবে না। অন্য যে কারণগুলো রয়েছে তুরস্কের এই অভ্যুত্থানে, সেগুলোও কাজ করেনি বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তবে কারো কারো ধারণা, এখানে বাইরের কোনো শক্তির ইন্ধন থাকতে পারে। হোক সেটা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়া। এর বাইরে ‘আদর্শিক’ কোনো ‘মোটিভ’ থেকে এ অভ্যুত্থানচেষ্টা হয়েছে কি না, সেটাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এই অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে।
একবিংশ শতকে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা কম ঘটলেও ২০১৩ সালে মিসরে ঘটে যাওয়া সেনা অভ্যুত্থান পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই অভ্যুত্থানে মাধ্যমে মিসরের ইতিহাসে প্রথম গতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। অনেকেই ধারণা করছিল, তুরস্কেও হয়তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে।
কিন্তু দুটো দেশের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। এরদোয়ান ও তার দল তুরস্কের ক্ষমতায় আছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। আর মুরসি ক্ষমতায় ছিল মাত্র এক বছর। যদিও মুরসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছিল (যেমন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস, অতি ইসলামীকরণ, বিরোধীদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ) এরদোয়ানের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে। মুরসির পক্ষে সে দেশের অধিকাংশ জনগণ, বিশেষ করে ডানপন্থীদের সমর্থন থাকলেও বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি, মিডিয়া ও সুশীল সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামে। এবং তারা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের পর হাতে পাওয়া গণতন্ত্রকে শুধু ‘আদর্শিক দ্বন্দ্বের’ কারণে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কবর দেওয়া হয়। এ যেন নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো। আর ক্ষমতার লালসায় ওত পেতে থাকা সেনাবাহিনীও সুযোগ বুঝে মিসরের ক্ষমতা দখল করে নিল। কিন্তু তুরস্কের এই সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে এমন কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য কোনো গোষ্ঠীকে দেখা যায়নি।
তুরস্কের এ ঘটনা দেশপ্রেমের নিদর্শনের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বিপথগামী সেনাদের এই অভ্যুত্থান সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তারা কোনো রাজনৈতিক শক্তি কিংবা দলের সমর্থন না পাওয়া। এমনকি বিরোধী দলগুলো সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান তুলে ধরে। তারা প্রকাশ্যে এই অভ্যুত্থানের নিন্দা করে। সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একক অবস্থান তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও দেশের প্রতি সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। তারা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের চেয়ে দেশ, দেশের গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছে। অন্যান্য দেশের রাজনীতিবিদদের এখান থেকে শেখার আছে অনেক কিছ্।
অভ্যুত্থান ঘটনার সময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মোবাইলের মাধ্যমে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনতা রাস্তায় নেমে আসে। অভ্যুত্থানকারী ও ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে জনগণের এমন গণজোয়ার পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় না বললেই চলে। নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সমগ্র তুরস্কে জনতা ট্যাঙ্কের সামনে পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ বা ট্যাঙ্কের সামনে শুয়ে পড়ে। জনগণ তাদের জীবন বাজি রেখে নিজেদের বুক বিছিয়ে দেয় ট্যাঙ্কের নিচে। বলা যায়, জনগণই এই সেনা অভ্যুত্থানটিকে ঠেকিয়ে দেয়।
জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস—এটি যেমন আরেকবার প্রমাণিত হলো। জনতা চাইলে যেকোনো অপশক্তিকে পরাজিত করতে পারে, সেটাই যেন জানান দিল তুরস্কের জনগণ। পৃথিবীতে যে বা যারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে চায় কিংবা ক্ষমতা দখল করতে চায়, তাদের জন্যও তুর্কিরা একটি বার্তা দিয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইকারীরা যেন এখান থেকে নতুন রসদ পেল। জনগণের শক্তি যে ফুরিয়ে যায়নি, জনগণ চাইলে যেকোনো পরিবর্তন সম্ভব, সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বন্দুকের নলের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। জলপাই রঙের যন্ত্র আর যন্ত্রমানবরা আর যাই করুক, শাসন করার অধিকার রাখে না। ‘পিস কাউন্সিল’ নাম নিয়ে যারা ক্ষমতা দখল করতে এসেছিল, তারা যে শান্তি প্রতিষ্ঠার বদলে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে, তা জনতা বুঝতে পেরেছে। তাই প্রেসিডেন্টের ডাকে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমে ট্যাঙ্কের ওপর উঠে গাইল গণতন্ত্রের জয়গান।
লেখক : গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।