হিলারির রানিংমেট অভিজ্ঞ ও প্রগতিশীল টিম কেইন
হিলারি ক্লিনটনকে মার্কিন গণমাধ্যম দেখে ধীরস্থির, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। বলা হয়, নিশ্চিত না হয়ে তিনি এক পাও দেন না। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভার্জিনিয়ার সিনেটর টিম কেইনের বাছাইকেও সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছে গণমাধ্যম।
রানিংমেট নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে যেকটি নাম আলোচনায় ছিল, তার একটি সিনেটর টিম। এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেছেন। মার্কিন রাজনীতিতে একটি ‘সুইং স্টেট’ বা ‘দোদুল্যমান রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত ভার্জিনিয়া।
জনপ্রিয় সিনেটর টিমকে সঙ্গী করার সুবাদে সুইং স্টেটে ভোটের রাজনীতিতে হিলারি সুবিধা পাবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি কেইনের আছে প্রশাসনিক ও আইন সভা, দুই ধরনেরই কাজের অভিজ্ঞতা। সিনেটর হওয়ার আগে টিম ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভার্জিনিয়ার গভর্নর ছিলেন। এর আগে তিনি ছিলেন রিচমন্ড শহরের মেয়র। এই ক্যাথলিক ছাত্রজীবনে মিশনারি কাজেও যুক্ত ছিলেন। অনর্গল স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে পারেন টিম। সিনেটে স্প্যানিশ ভাষায় একটি পুরো বক্তৃতা দিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রানিং মেট নির্ধারণের সময় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সময়ের আলোচিত ইস্যুগুলোকে সাধারণত বিবেচনায় রাখেন। ভোটের গাণিতিক হিসাবও এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বারাক ওবামার নাম্বার টু হওয়ার শর্ট লিস্টেও ছিলেন কেইন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন পাননি। সে নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৎকালীন সিনেটর ওবামার দুর্বলতা অন্যতম ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। সে ইস্যুকে মোকাবিলা করতে সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান জো বাইডেনকে রানিংমেট করেন ওবামা। তাঁর সে সিদ্ধান্তটি সেদিন দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। ওবামার সঙ্গে বাইডেন যুক্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইস্যু দিয়ে আর তাকে ঘায়েল করা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন মার্কিন সমাজে অন্যতম আলোচিত ইস্যু নিরাপত্তা। পৃথিবীব্যাপী সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান মার্কিনিদের মনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নানা উক্তি বহুক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপত্তায় হুমকি ডেকে আনছে। তাই হিলারির উপদেষ্টারা রানিংমেট হিসেবে এমন কাউকে চাইছিলেন যার নিরাপত্তা-প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা আছে। সে কারণে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত একাধিক জেনারেলের নামও এসেছিল। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সিনেট কমিটির সদস্য হওয়ায় টিম কেইন শেষ পর্যন্ত সেরা পছন্দ হিসেবে আবির্ভূত হন।
২০০৮ সালে ওবামার নেওয়া আরো একটি কৌশল হিলারি অনুসরণ করেছেন। সেবার ইমেইল এবং এসএমএসে নিজের সমর্থকদের সবার আগে রানিংমেটে হিসেবে বাইডেনের নাম জানিয়েছিলেন ওবামা। এবার হিলারিও তাই করলেন। টিম কেইনকে স্বাগত জানিয়ে ইমেইল বার্তায় হিলারি লিখেছেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, টিম কেইনকে আমার রানিং মেট হিসেবে চূড়ান্ত করেছি’।
নিজের সিদ্ধান্তে ব্যাখ্যা দিয়েছেন হিলারি, ‘আমার মতোই টিম যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে বড় হয়েছেন। আইন নিয়ে লেখাপড়া করার সময় তিনি অপ্রচলিত পথ বেছে নেন। মিশনারীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি হন্ডুরাসে চলে যান। একইসঙ্গে সেখানে নিজের বিশ্বাস ও স্প্যানিশ ভাষার চর্চা করেন তিনি। দেশে ফিরে এসে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে লেখাপড়া শেষ করেন। তিনি যে কোনো কিছুই করতে পারতেন। কিন্তু বড় কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী হিসেবে যোগ না দিয়ে তিনি হাউজিং বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করলেন এবং একজন নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত আইনজীবী হিসেবে রিচমন্ডে কাজ শুরু করলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী চার্চে যোগ দিলেন। নিজেদের বিশ্বাস দিয়ে ঘর বেঁধেছেন এবং সেখানে তিন সন্তানকে বড় করে তুলেছেন। ১৭ বছর আইন পেশায় যুক্ত থাকার পর টিম সিটি কাউন্সিলের নির্বাচন করেন এবং জয়লাভ করেন।’
কেইন একাধিকবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সিটি কাউন্সিলে কাজ করতে করতে তিনি রাজনীতি শিখেছেন। গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে। জীবনে এখনো পর্যন্ত হারেননি কোনো নির্বাচনে। হিলারিও অনুধাবন করতে পেরেছেন এটা, ‘আমি যখন রানিং মেটের বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করছিলাম তখন রিপাবলিকান বা ডেমেক্রোট কেউই টিমের ব্যাপারে কোনো খারাপ মন্তব্য করেনি। গত ২০ বছরে টিমের সঙ্গে তাঁর যে কর্মীরা কাজ করেছেন বা তাঁর সিনেটের সহকর্মীরা সবাই তাঁকে ভালোবাসেন। তিনি সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ। আমেরিকান পরিবারগুলোর জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মাইক পেন্সের বিরুদ্ধে আমাদের প্রচারণায় তিনি যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।’
সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনসহ হেভিওয়েট প্রার্থীদের বাদ দিয়ে কেইনকে পছন্দ করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে হিলারি তাঁর সমর্থকদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই এই বলে যে, অনেক ভেবেচিন্তেই কেইনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।’
হিলারির পছন্দের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান প্রেসিডেন্ট ওবামাও। এমনকি কেইনকে অভিনন্দন জানিয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে তিনিও ইমেইল-বার্তা পাঠিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর ইমেইল-বার্তায় লিখেছেন, ‘আমি খুবই গর্বিত যে হিলারি তাঁর রানিং মেট হিসেবে সিনেটর টিম কেইনের মতো লোককে বেছে নিয়েছেন’।
হিলারির নেওয়া এ সিদ্ধান্তকে নিজের রানিংমেট বাছাইয়ের সঙ্গেও তুলনা করেন ওবামা। তাঁর মতে, ‘প্রেসিডেন্সিয়াল প্রার্থী হিসেবে রানিং ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আর কিছু হতে পারে না। আপনি দুটি পথ বেছে নিতে পারেন। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে আপনি কাউকে বেছে নিতে পারেন অথবা আপনি এমন কাউকে বেছে নিতে পারেন যিনি আপনার সরকারে আপনার সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করবেন। এমন কেউ যে আপনার বিশ্বাস, মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এমন কেউ যে আপনাকে একজন ভালো প্রেসিডেন্ট হতে সাহায্য করবে। সে কারণেই আমি জো বাইডেনকে বেছে নিয়েছিলাম। হিলারির জন্যও সে রকমভাবে টিম কেইন সঠিক ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।’
২০০৮ সালের প্রাইমারিতে প্রথম যে কজন ডেমোক্র্যাট নেতা ওবামাকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন ভার্জিনিয়ার তৎকালীন গভর্নর কেইন। ওবামার প্রেসিডেন্সির প্রথম মেয়াদে কেইন ডেমোক্রেট পার্টির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। দীর্ঘদিনের এই সম্পর্কের আলোকে ওবামা মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে অনেক উঁচু পর্যায়ে উঠে এলেও টিম এখনো রিচমন্ডের সে সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করেন।
ওবামা তাঁর ইমেইল-বার্তায় লিখেছেন, ‘টিম খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করলেও এখনো তিনি রিচমন্ডের সেই এলাকাতেই থাকেন যেখান থেকে তিনি সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। টিম একজন ভালো মানুষ। সত্যিকার অর্থেই তিনি প্রগতিশীল এবং তিনি গুরুত্বপূর্ণ একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন।’
নিজের সম্পর্কে কেইন বলেছেন, তিনি একজন ইতিবাচক মানুষ। ছোট বেলায় মা তাঁকে এই শিক্ষা দিয়েছিলেন। সে শিক্ষাকে ধারণ করেই তিনি এগিয়ে চলেছেন। কেইন বলেন, “আমার মা একসময় আমাকে বলেছিলেন, ‘টিম তোমাকেই ঠিক করতে হবে তুমি কি সঠিক হতে চাও নাকি সঠিক কাজটি করতে চাও। যদি তুমি সঠিক হতে চাও তাহলে দুঃখবাদী হও। আর তুমি যদি সঠিক কাজটি করতে চাও তাহলে আশাবাদী হও।’ তখন থেকেই আমি আশাবাদী। এবং মিশনারীদের সঙ্গে যখন থেকে আমি কাজ করা শুরু করি আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে।”
ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন ইন্ডিয়ানা গভর্নর মাইক পেন্সকে। ট্রাম্প-পেন্সদের অতি ডানপন্থী প্রচারণার বিপরীতে নিজেদের প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ হিসেবে তুলে ধরছেন হিলারি-কেইন। কেইন বলেছেন, ‘হিলারি এবং আমার দুজনেরই শক্ত প্রগতিশীল কিছু বিষয় রয়েছে এবং আমরা সেখান থেকে সরে আসব না। আমরা এমন একটি অর্থনীতি তৈরি করতে চাই যা সবার জন্যই কাজ করবে। আমরা কলেজগুলোকে ঋণমুক্ত করব। আমরা অভিবাসন কাঠামোকে সংশোধন করব, আমরা কর্মক্ষেত্রে বেতনসহ পারিবারিক ছুটির জন্য লড়াই করব, নারী সমতা এবং শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব।’
বিশ্লেষকদের মতে, হিলারি-কেইন মার্কিন রাজনীতিতে হয়তো সেরা জুটি নন। তবে মিসেস ক্লিনটন জানেন তিনি কী করছেন, কাকে নিয়ে করছেন। ভোটের সমীকরণ মাথায় রেখেই তিনি ঠান্ডা মাথায় বেছে নিলেন নম্বর টু। বেশির ভাগ ডেমোক্রেট মনে করেন এই পছন্দ ৮ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর জয় নিশ্চিত করবে। রানিংমেট বাছাইয়ে তাই ট্রাম্পের তুলনায় হিলারিকে বেশি পয়েন্ট দিচ্ছেন মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন।