সোজাকথা
বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া দুই পক্ষই অস্বস্তিতে
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/07/29/photo-1469783795.jpg)
অন্ধকারে জুজুবুড়ির ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেন মায়েরা। অচেনা না দেখা জুজুবুড়ি আসবে, সেই ভয়ে কুঁকড়ে কখন যে ঘুমিয়ে যেত বাচ্চারা, টেরই পেত না। এই ভয় অনেক সময় সেই বাচ্চাদের বড় হওয়ার পরও যেত না। অন্ধকার দেখে ভয়। অজানা জুজুবুড়িকে ভয়। এখন আমাদের সবার মধ্যেই সেই জুজুবুড়ির ভয়—ভয় দেখাচ্ছে সন্ত্রাসী অতর্কিত জঙ্গিরা, জঙ্গিরা আসবে সেই ভয় দেখাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও, সেই ভয় দেখানোর তালিকা দিন দিন বেড়েই চলেছে, তালিকায় এখন বাড়িওয়ালারা, পথচলতি পাশের অচেনা মানুষটিও, অফিস-আদালত, শপিংমল, রেস্তোরাঁ কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। চারপাশে যেদিকে তাকাই না কেন, সবাইকে জঙ্গি মনে হয়।
জঙ্গির তো আলাদা কোনো চেহারা নেই, একই রক্তমাংসের মানুষ। শিক্ষিত, স্মার্ট, ঝকঝকে যে তরুণটি আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে, সে-ই জঙ্গি কি না নিশ্চিত হবেন কী করে? এমনই একটা থমথমে অবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করছি। এই জঙ্গিরা কোনো অজানা দ্বীপে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে লুকিয়ে থাকছে না। এরা আমার-আপনার সঙ্গে মিশে আমাদের মধ্যেই থাকছে। আর সুযোগমতো হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর থেকে জঙ্গি সম্পর্কে নানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর পরপরই কল্যাণপুরে আবাসিক এলাকায় জঙ্গি আস্তানা ‘আবিষ্কারে’র পর জঙ্গিদের পরিচয় বেরিয়ে আসায় আতঙ্কের পাশাপাশি এখন নতুন যোগ হয়েছে বিড়ম্বনা, যার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে ভাড়াটিয়ারা। আরো বিশেষ করে বললে ব্যাচেলররা। শুধু যদি ঢাকার কথাই বলি, এখানে স্থায়ী বাসিন্দাদের কয়েক গুণ মানুষ থাকে অস্থায়ীভাবে, যাঁরা কেউ ঢাকায় এসেছেন চাকরি করতে, কেউ চাকরি খুঁজতে, কেউ এসেছেন পড়াশোনা করতে, অর্থাৎ এমন নানান প্রয়োজনে ভাগ্য বদলাতে লাখে লাখে মানুষ ঢাকায় পাড়ি জমান। এঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে ঢাকায় গড়ে উঠেছে অনেক মেসবাড়ি।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাড়িওয়ালারা ফ্যামিলি বাসা ভাড়া দেওয়ার চেয়ে মেস ভাড়া দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে আলো-বাতাস ঢুকুক না ঢুকুক, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ থাকুক না থাকুক, সেই বিষয়ে বাড়িওয়ালাদের মাথাব্যথা নেই। তারা ব্যাচেলরদের থাকার সুযোগ দিচ্ছেন, এতেই ধন্য হতে হতো সদ্য গ্রাম থেকে আসা তরুণদের। এমনিতেই ঢাকায় মনের মতো একটা বাসা ভাড়া পাওয়া সাধ্যের বাজেটে অনেকটা সোনার হরিণ পাওয়ার মতোই। তার ওপর বছর বছর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়া বাড়ানোর যন্ত্রণা। বাড়িওয়ালাদের লেজে পাড়া দেবে, এমন সাধ্য কার। জঙ্গি আতঙ্কে এখন সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়তে হলো ব্যাচেলরদের। বাড়িওয়ালার বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পেয়ে গেছেন অনেকেই, তার ওপর বিষফোড়া যোগ হয়েছে পুলিশের হয়রানির আতঙ্ক।
চাকরির কারণে যেসব ব্যাচেলর বাসা ভাড়া নিয়ে মেস বানিয়ে থাকেন এবং লেখাপড়ার কারণে হলে সিট না পাওয়ায় যে শিক্ষার্থী ছাত্র মেসে থাকেন, তাঁরা এখন কী করবেন? একদিকে ভয়, যেকোনো রাতে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারে; টাকা না দিলে ‘জঙ্গি তকমা’ দেবে; অন্যদিকে জঙ্গি হামলার শঙ্কা। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ের চিত্র প্রায় অভিন্ন। অজানা আতঙ্কেই জুমার নামাজে মসজিদগুলোতে তরুণ মুসল্লির উপস্থিতি কমে গেছে। এসব বিড়ম্বনার কথা আমি শুনলাম আমার মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে। ও পড়ছে আইইউবিতে। থাকে আবদুল্লাহপুরে একটি মেসে কয়েকজন মিলে। জঙ্গি আতঙ্কের পর নাকি ওদের বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে। আমার ভাইটি নিয়মিত নামাজ পড়ে। এখন মসজিদে গেলে নাকি লোকজন ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। এলাকার থানায় ওদের এনআইডিসহ সব তথ্য নিজেরাই গিয়ে জমা দিয়ে এসেছে, যাতে কোনো রকম ঝামেলা না হয়। তারপরও ওই থানার পুলিশরাই নাকি ওদের মাঝেমাঝে পথে আটকে টাকা নেয়, না দিতে চাইলে বলে জঙ্গি মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। অথচ বিনা কারণে ওদের বাড়িওয়ালা যখন হুট করে বছরের মাঝখানে ভাড়া বাড়াত, তখন পুলিশের সহায়তা চেয়েও কোনো লাভ হয়নি। এখন বাড়িওয়ালা-পুলিশ সবাই মিলে হয়রানি করছে এই ঢাকার বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীদের।
এ ঘটনা নিশ্চয়ই শহরের আরো অনেক এলাকাতেই হচ্ছে। আমার ভাইয়ের কাছে না শুনলে এইদিকটার কথা জানতেই পারতাম না। ও এখন পড়াশোনা বন্ধ রেখে বাড়ি ফিরে যেতে চাইছে। আমার ভাইটি না হয় ঢাকায় ওর অনেক আত্মীয় আছে বলে এখানে থেকে পড়ার সুযোগ পাবে, আর যেসব ছেলের কেউ নেই এই অজানা শহরে, তারা এখন কী করবে? ওদের স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে?
মুদ্রার ওপীঠও কিন্তু আছে। বাড়িওয়ালারাও কিন্তু কম ভীতিতে নেই। তাদের ভীতি ভাড়াটিয়া নিয়ে। কোন ভাড়াটিয়াকে কখন জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তার করে ‘আস্তানা’ দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। থানা থেকে ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে তথ্য দিতে বলা হচ্ছে। সবাই কিন্তু উইলিংলি দিচ্ছেন সব তথ্য। কিন্তু ভাড়াটিয়া সঠিক তথ্য দিচ্ছেন কি না, সেটা কীভাবে বাড়িওয়ালা বুঝবেন? যারা জঙ্গি, তারা তো অনেক ছক কেটেই পথে নামে। হয়তো এখন ব্যাচেলরদের ওপর নজরদারি হচ্ছে বলে তারা অন্যপথ বেছে নেবে। এমন তো নয় যে মেয়েরা এই পথে পা বাড়ায়নি। আমরা তো দেখছি, পুলিশের নিখোঁজের তালিকায় মেয়েরাও আছে। শুধু ঢালাওভাবে ব্যাচেলরদের এমন বিপদে ফেলার কী মানে?
স্টেশন, নৌবন্দর সবখানে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তা জোরদারের কথা বলা হচ্ছে। আর জঙ্গি খুঁজতে পুলিশের তৎপরতাও করে তুলেছে সন্ত্রস্ত। আর যাদের গ্রেফতার আতঙ্ক নেই, তারাও জঙ্গি হামলার গুজবে আতঙ্কে দিনযাপন করছেন। কেউ জানে না, কখন কোথায় কী অঘটন ঘটে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক-ভীতি দূর হচ্ছে না। কখন কোথায় কী হয়, সে আশঙ্কায় নিত্যদিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার পারদ বাড়ছেই। পত্রিকার পাতা খুললেই জঙ্গির খবর। টিভির নিউজ ও অনলাইন মিডিয়ায় একই বার্তা। দেশি-বিদেশি সব প্রচারমাধ্যম দখল করেছে জঙ্গিনামা।
মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম বদলাচ্ছে না। কিন্তু প্রতিদিনই দায়িত্বশীলদের বাগাড়ম্বরের শিরোনাম বদলাচ্ছে। সন্ত্রাসের শিকড় উৎপাটন করব, ঠেকিয়ে দেব ইত্যাদি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলার খবর আমরা আগেই জানতাম, তথ্য আমাদের হাতে ছিল। প্রতিদিন কোনো না কোনো মন্ত্রী আশঙ্কা করছেন, এখানে হামলা হতে পারে, ওখানে হামলা হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলে হুঙ্কার দিয়ে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ানো ছাড়া এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর কিছু করে দেখাতে পারেননি। যদি তারা পারতেনই, তবে এত ধোঁয়াশা কেন? গুলশানে কূটনৈতিকপাড়ায় নিরাপত্তার এত চেকপোস্ট বসানো হলেও কীভাবে এতগুলো জঙ্গি সেখানে প্রবেশ করল—সে প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি।
সমস্যা হলো, একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগেই নতুন প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। আর প্রশাসন সরকার হাঁফ ছেড়ে পুরোনো সমস্যা ভাঁজ করে তুলে রেখে নতুন সমস্যা নিয়ে হম্বিতম্বি শুরু করে। গুলশানে এখন পাবলিক বাস প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা প্রাইভেট গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহনে চলাফেরা করতে পারছেন, তাঁদের তল্লাশির নামে হয়রানি করা হচ্ছে। মানুষের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় ওই এলাকার মার্কেট এবং হোটেলগুলোর ব্যবসা নষ্ট, জীবনের স্বাভাবিকতাই নষ্ট জনসাধারণের। ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনতে শুরু করেছেন। গুলশান-বারিধারা-বনানীতে বসবাস করা পরিবারগুলোর তরুণদের মা-বাবা আতঙ্কে রয়েছেন। রাজধানীর সব জায়গাতেই এমন অবস্থা, বরং বলা ভালো সারা দেশেই এখন এক অবস্থা। এক আতঙ্কের জনপদ যেন আমাদের এই দেশ। অথচ এমনটা কখনোই মানায় না এ দেশের সঙ্গে, এ দেশের মানুষের সঙ্গে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অবশ্যই জঙ্গিবাদ ঠেকাতে হবে। সাধারণ মানুষ এখন অনেক সচেতন। সবাই মিলে যাতে জঙ্গিবাদ ঠেকানো যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। এখানে রাজনীতির ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের লোভ ত্যাগ করতে হবে দেশের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে। কারণ, এই জঙ্গিবাদ কখনো আপনাকে টার্গেট করবে না, সেটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কাজেই পরের জন্য গর্ত খুঁড়তে গিয়ে নিজের পড়া ঠেকানো যাবে না। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রক্ষকের ভূমিকায় নিজেদের হৃত সম্মান ফিরিয়ে আনতে যত্নবান হতে হবে।
লেখক : সিরিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।