দৃষ্টিপাত
উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ও উচ্চশিক্ষার সংকট
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে এবারের পরীক্ষায় চমক দেখিয়েছে যশোর বোর্ড এবং পিছিয়ে রয়েছে কুমিল্লা বোর্ড। জিপিএ ৫-এর সংখ্যা ৫৮ হাজার ২৭৬, পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭০। একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী এবারও অকৃতকার্য হয়েছে। বাহ্যিক হিসাবে এবারের ফল অন্যান্য বারের চেয়ে অনেক আশাব্যঞ্জক। শিক্ষার্থীরা বিশেষ কিছু বিষয়ে সাফল্য দেখিয়েছে, এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।
তবে এবারও সেই একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে আসছে, এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পারবে তো তাদের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থান করে নিতে? দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রতিবছরই লক্ষ করা যায়।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য ঘোষণা দিয়েছেন, পাস করা সব শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আসনসংখ্যা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। সত্যিকার অর্থেই যদি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় তবে মঙ্গল, সে ক্ষেত্রে এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য স্থান সংকুলান করা যাবে কি না, সেটি দেখতে আমাদের আরো কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে এখনো অনেক বিষয় ঘোষণার পর্যায়েই থেকে যায়।
এর চেয়েও বাস্তব পরিস্থিতি হলো আমাদের সন্তানদের জন্য এখনো পর্যাপ্ত সুযোগ আমরা তৈরি করতে পারিনি, যার ফলে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অকল্পনীয় চাপ পড়ে এই সময়টিতে। শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গন হিসেবে পরিচিত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়।
দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংবাদ বলছে, পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার আসন সংকুলান হবে না, অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১০টি শিক্ষা বোর্ডে পাস করেছে আট লাখ নিরানব্বই হাজার ১৫০ শিক্ষার্থী, অন্যদিকে এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরো ৪৩ হাজার আসন বাড়াতে হবে।
এই সংকটকে আরো প্রকট করেছে কর্মমুখী শিক্ষার অভাব, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেক বেশি পুস্তকভিত্তিক। শুধু পুস্তকভিত্তিক হওয়ায় কারিগরি জ্ঞানের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না আমাদের। এ ছাড়া অভিভাবকদের মধ্যেও একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে তাঁদের সন্তানদের অবশ্যই বড় ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি পেতে হবে।
চাকরি ছাড়াও যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে বা বিকল্প উপায়ে অভূতপূর্ব উন্নতি করা যায়, সে বিষয়টি যেন আমরা ভুলে যেতে বসেছি। আমরা যেন মনে রাখি, আমাদের সন্তানরা উদ্যোগ নেওয়ার সাহস হারালে দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য প্রথাগত ডিগ্রির বাইরেও যার যেদিকে আগ্রহ, সেই কার্যকর পথের সন্ধান আমাদের করতে হবে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংস্কৃতিমন্ত্রীর বক্তৃতার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। তিনি সেখানে বলছেন, একজন শিক্ষার্থীর মা তাঁর (মন্ত্রী) কাছে প্রাথমিক পর্যায়ে চারুকারু এবং শরীরচর্চা শিক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভদ্রমহিলা জানতে চেয়েছেন, চারুকারুর পাঠ নিয়ে তাঁর সন্তান কি জয়নুল আবেদিন হবে? যাই হোক, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন, তবে কথা হলো যে আমাদের সন্তানরা সবাই সরকারি চাকুরে হবে, এটিও যেন আমাদের কাম্য না হয়, অবশ্যই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে জয়নুল আবেদিনদের আসতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, এস এম সুলতান, শাহ আবদুল করিম, ফকির লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলদের অবশ্যই আসতে হবে এই দেশে।
সকলে প্রথাগত উন্নতির রাস্তা খুঁজলে নব নব উন্নতির পথ তৈরি হবে না, মেধার বিকাশ ও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। দেশে যথেষ্ট সুযোগ নেই, মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা নেই—এসব কথা বলে আমরা আমাদের দায় এড়াতে পারব না। তরুণ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য অগ্রজ হিসেবে আমাদের কর্তব্য অনেক। এসব কর্তব্য পালনে অবহেলা হলে তখনই মূলত তরুণদের বিপথগামী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়।
কোমলমতি সুন্দর মনের অধিকারী আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা যেন মসৃণ পথ তৈরি করে যেতে পারি, সে বিষয়টি আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, নয়তো আগামীর বাংলাদেশ ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। তাদের সামনে সমান সুযোগ, সম্মানজনক পরিবেশ ও রীতিনীতি এবং সুষ্ঠু-সুন্দর গণতান্ত্রিক বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার পরিবেশ উন্মুক্ত করার মাধ্যমেই মূলত আসতে পারে সেই সুদিন।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন।