অভিমত
কেমন হবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রক্রিয়া?
সম্প্রতি উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বেরিয়েছে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নিজেদের প্রস্তুত করছে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য; বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুদিনের মধ্যে এই নবীন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠবে। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিষয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীরা ছুটবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা আসবে শহরে, এক প্রান্তের শিক্ষার্থীরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটবে দেশের অপর প্রান্তে। অভিভাবকদেরও যেন এ লড়াই থেকে মুক্তি নেই। সন্তানের জন্য একটি ভালো প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে অভিভাবকদেরও গলদঘর্ম দশা। শিক্ষার্থীদের জন্য ভোগান্তির যেন অন্ত নেই এই যুদ্ধে। আজ ঢাকায় পরীক্ষা শেষ না হতেই আগামীকাল ছুটতে হচ্ছে চট্টগ্রাম, পরদিন খুলনা।
এসব বিষয় মাথায় রেখেই বেশ কিছুদিন ধরে কথাবার্তা চলছে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের। এমন একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে, যেখানে একবার পরীক্ষা দিয়েই রেহাই পাওয়া যাবে, ঘুরে ঘুরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটতে হবে না। এটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির কথা। বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে এ পদ্ধতি চালু আছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমেছে, মা-বাবার দুশ্চিন্তা কমেছে, আর্থিক ক্ষতি কমেছে, সর্বোপরি কমেছে দুর্ভোগও।
এখন বাংলাদেশের মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই পদ্ধতির কথা কেউ কেউ জোরেশোরে বলছেন, এর পক্ষে-বিপক্ষেও বিস্তর তর্ক চালু আছে। মন্ত্রী-শিক্ষকদের মধ্যেও এ নিয়ে যুক্তি-পাল্টাযুক্তি আমরা দেখেছি বিগত দিনে। সত্যিকার অর্থেই এই গুচ্ছ পদ্ধতির ভালো-মন্দ দুই দিকই রয়েছে।
আমাদের দেশে এখনো সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে আমাদের দুর্ভোগের মাত্রা চরমে ওঠে। আমাদের শিক্ষার্থীরা চাইলেই পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারে না, অনেক সময় বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানের চাপিয়ে দেওয়া বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক, ইউনিটভিত্তিক আলাদা পরীক্ষা পদ্ধতি চালু থাকায় এখনো কিছু সুযোগ অবশিষ্ট রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে, পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পারছে এখনো। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এখনো বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে।
ধরা যাক, উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়া একজন শিক্ষার্থীও এ ক্ষেত্রে কলা অনুষদে পরীক্ষা দিতে পারছে। অনেক সময় দেখা যায়, তারা চলচ্চিত্র, নাটক, চারুকলা কিংবা সংগীতের মতো বিষয়ে পড়ছে নিজেদের আগ্রহের কারণে এবং শেষ পর্যন্ত তারা ভালোও করছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিষয়ে অভাবনীয় ফল করছে। আমরা দেখেছি, কেউ কেউ দেশসেরা গবেষকও হয়েছেন।
আসনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি হওয়ার কারণে আমরা এমনিতেই তাদের উপযুক্ত জায়গা দিতে পারছি না। গুচ্ছ পদ্ধতি চালু হলে এখন যে সুযোগটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকুও নষ্ট হবে। দেখা যাবে, স্নাতক পর্যায়ে যার চলচ্চিত্র পড়ার ইচ্ছে ছিল, তাকে পড়তে হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা অর্থনীতি। আবার দেখা গেল, যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রে আগ্রহ ছিল, তার ভাগ্যে জুটেছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান। এটি সত্যি যে, এখন ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন একটি বাহ্যিক নৈরাজ্য চালু আছে; কিন্তু তখন দীর্ঘ মেয়াদে একটি অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য স্থান করে নেবে।
অনেকে হয়তো বলবেন, এ দেশে বিষয়ভিত্তিক পড়ে লাভ কী হচ্ছে, চাকরির বাজারে তো সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। যে প্রাণরসায়ন কিংবা পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে, পড়াশোনা শেষে সে যেমন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ছে, তেমনি নৃবিজ্ঞান কিংবা চলচ্চিত্রে পাস করা শিক্ষার্থীকেও একই কাজ করতে হচ্ছে। এ কথা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত, তবে প্রসঙ্গ ভিন্ন। এটি আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা ওই সব গ্র্যাজুয়েটের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারিনি। আর এ জন্যই এই করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কেউ কেউ আবার মেডিকেলের যুক্তি তুলে ধরবেন, সেখানে তো একটি পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের রেহাই দেওয়া হচ্ছে, সরকারি থেকে বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি পরীক্ষা। এই যুক্তিও ফেলনা নয়। তবে কথা হলো, মেডিকেল কলেজ এবং মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রেক্ষাপট, কর্মক্ষেত্রের পরিধি, পরিবেশ ও পরিস্থিতি এক নয়, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন নৈরাজ্য দূরীকরণে একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠানই একমাত্র সমাধান নয়। সে ক্ষেত্রে বহু বিকল্প রয়েছে, যাতে দুই কূলই রক্ষা করা সম্ভব। কাছাকাছি ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা ইউনিটের অধীনে পরীক্ষা হতে পারে, গুচ্ছ পদ্ধতিতে একটি পরীক্ষাই একমাত্র সমাধান নয়।
আমাদের সন্তানদের স্বপ্নগুলো পরিচর্যায় আমাদেরই সতর্ক এবং মনোযোগী হতে হবে। তাদের স্বপ্ন, তাদের শ্রম ও সাধনার ওপরেই গড়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশ।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।