আন্তর্জাতিক
জন কেরির সফরনামা
ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নেওয়ার বার্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাওয়ায় এ সফরে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন তিনি। তবে বাংলাদেশের সতর্ক কূটনৈতিক উচ্চরণে তাদের ‘ব্লাঙ্কচেক’ দেওয়া হয়নি বলেই মনে হয়। জন কেরি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে সরাসরি ঢাকায় এই সংক্ষিপ্ত সফরে আসেন। সকাল-সন্ধ্যার এ সফরে তিনি অতি ব্যস্তময় সময় কাটান। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন।
আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছিলেন, নিরাপত্তা সহযোগিতার বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। ঢাকা ওয়াশিংটনকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা জানায়। কেরিকে আরো জানানো হয়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সামর্থ্য অর্জন করছে এবং প্রয়োজন হলে বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে সহযোগিতা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এম জিয়াউদ্দিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সহযোগিতার বিষয়টি জন কেরির আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী। আলোচ্য সূচি দেখে মনে হচ্ছে, মার্কিনিদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় নিরাপত্তা তথা সন্ত্রাসকে আর বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয় ব্যবসা বিনিয়োগ ও উন্নয়নের ওপর। বাংলাদেশের তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধুর এক খুনিকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইনানুগ উত্তর দেন। সফরের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে যতটা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উত্থান বর্ণনা করা হয়, ততটা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের ছিল না। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র স্বীয় স্বার্থে বাংলাদেশের ঘটনাকে বেশি ‘রূপ-রস-গন্ধ’ দিয়ে প্রচার করছে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আইএসের অবস্থান প্রশ্নে মতভেদের কথা উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশ সরকার অসংখ্যবার বলেছে, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য শক্তি বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট কসরত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে অবস্থিত ‘সাইট’ নামক নেটওয়ার্ক অতি সামান্য ঘটনাকেও আইএসের কাজ বলে প্রচার করেছে।
এ প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশে মার্কিন হস্তক্ষেপের পটভূমি তৈরির প্রয়াস ছিল বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। এখন জন কেরি অবশ্য স্বীকার করছেন যে বিষয়টি ‘হোমগ্রোন’। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে হোমগ্রোন সমস্যাকে মোকাবিলার জন্য যথার্থ সুপারিশ প্রদান করলেন। তিনি গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সন্ত্রাসী তৎপরতার মোকাবিলার নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন জন কেরি। নাগরিক অধিকার, বিশেষত বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে গুরুত্ব দেয়, সেটি তিনি জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। জন কেরির সফরের পূর্বাহ্ণে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস প্রচারিত তথ্যপত্রে বলা হয়, ‘আমরা একটি গণতান্ত্রিক, উদারপন্থী ও সহনশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন ভাগাভাগি করি। যে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সেতুবন্ধন এবং বঙ্গোপসাগরের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির ঠিকানা হবে। আমাদের বিশ্বাস, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনভাবে বিকশিত এবং মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়াটা গতিশীল ও নিরাপদ বাংলাদেশের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অপরিহার্য।’
গোটা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা বিকাশ ও উন্নয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিঘোষিত পররাষ্ট্রনীতির অপরিহার্য অংশ। তাদের এ ভূমিকা দেশে দেশে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বাংলাদেশে তারা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ দেখতে চায়, তাদের এ প্রতিশ্রুতি অনেক পুরোনো।
এখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে সেই শীতলতার জায়গায় কিছুটা উষ্ণতা দেখা দিয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, সব দেশের পররাষ্ট্রনীতি জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত-বিবর্তিত হয়। এ কথা মনে করার কোনোই কারণ নেই যে জন কেরি বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি অতি সদয় হয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তারই একটি অংশ হিসেবে জন কেরির বাংলাদেশ সফর। যেখানেই সন্ত্রাস, সেখানেই মার্কিন হস্তক্ষেপ। বিশ্বের যেখানেই সন্ত্রাস ঘটুক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় তা তাদের ‘জাতীয় নিরপাত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ’।
সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে তাই জন কেরি এলেন সন্ত্রাস থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে! গরজ বড় বালাই। এর আগে শতবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সন্ত্রাসের আইএস আবিষ্কার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আইএসের অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পায়নি। অবশেষে উভয় পক্ষ ‘বিদেশি সংযোগ’ শব্দে একমত হয়েছে। আইএস খুঁজে পাওয়া গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহান কর্তব্য (!) হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশে এসে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা।
এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জন কেরির সফর শাসক দলের জন্য ইতিবাচক। কারণ, তাঁরা এই সফরের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে পারছেন যে নির্বাচন-সংক্রান্ত আপত্তি এবং বিপত্তি তারা মীমাংসা করে ফেলেছেন। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক এবং উন্নয়ন সহযোগিতা। সেটি অর্জিত হয়নি। তবে পরোক্ষ সমর্থনে সরকার লাভবান হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দল আত্মতুষ্টি লাভ করছে এই ভেবে যে, গণতন্ত্রের পক্ষে অনেক কথা বলেছেন জন কেরি, যা প্রকারান্তরে তাদেরই বক্তব্য। এই স্বল্প সময়ে মার্কিন দূতাবাসে হলেও বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর বৈঠক গুরুত্ব বহন করে। সরকার নিশ্চয়ই চায়নি এ বৈঠক। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এই যে বৈদেশিক সাহায্য কামনা, এটাকে অনেকে সহজভাবে দেখছেন না। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে যাদের পা ফেলতে দেওয়া হচ্ছে না, তাদের এ ছাড়া আর উপায় কি? এ সাক্ষাৎকারে প্রমাণিত হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচোখা নীতি অনুসরণ করে না। তবে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমীকরণ বিরোধী দলের পক্ষে নয়। ঢাকা থেকে জন কেরি উড়ে গেলেন দিল্লি। সেখানে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হলো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান শক্তিধর চীনকে মোকাবিলাই এ অঞ্চলে চূড়ান্ত মার্কিন লক্ষ্য। সুতরাং বৃহৎ লক্ষ্য এবং বৃহৎ বাজারের তুলনায় বাংলাদেশের স্বার্থ খুবই নগণ্য।
সাম্প্রতিককালে বাণিজ্য থেকে পরমাণু সহযোগিতা পর্যন্ত ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বিস্তৃত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের প্রয়োজনে ভারত’ নীতিই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নে মার্কিনিদের ‘ইগো’ কাজ করতে পারে। আগামীতে হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের বিষয়টি আরো মনোযোগ আকর্ষণ করবে। সরকার পরিবর্তন হলেও বড় বড় রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না। জাতীয় স্বার্থের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ যদি হিলারি ক্লিনটনের সময়েও পাত্তা না পায়, তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। তার কারণ, জাতীয় স্বার্থেই তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জাতীয় স্বার্থে নাকি ক্ষমতার স্বার্থে পরিচালিত হয়, তা রীতিমতো একটি গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার।
ঢাকা সফরে জন কেরি যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, সর্বত্র তা প্রশংসিত হয়েছে। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহিদুল আনাম খান যথার্থই বলেছেন, ‘কূটনীতির শিল্পকলা যে ডোভারের প্রান্তসীমায় নিঃশেষ হয়ে যায়নি’, তা আবার প্রমাণ করেছেন জন কেরি। এত অল্প সময়ের মধ্যে সকলের কাছে পৌঁছে যাওয়ার প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসাজনক। ঢাকার কেনেডি সেন্টারে তাঁর গণসংযোগ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ কূটনৈতিক সফলতার নির্দেশক। কূটনৈতিক রীতি রেওয়াজ হলো কতিপয় আনুষ্ঠানিকতা এবং গতানুগতিক সৌজন্য সম্প্রীতির কথা বলা। আমরা আশা করি, জন কেরির সফর গতানুগতিকতার সীমারেখা অতিক্রম করে বাস্তবতা লাভ করবে। উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থে এই চমকপ্রদ সফরটি উত্তম উদ্যোগ হিসেবে ব্যবহৃত হোক কূটনৈতিক মহলে—এ রকমই আশাবাদ।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।