শিক্ষা
নির্বিঘ্ন ও স্বস্তির হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পদ্ধতি
বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বপ্নের আঙিনা, তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের বহুদিনের লালিত স্বপ্নের সোপান। নিত্যনতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার লীলাভূমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়, তখন কে না চায় এই জমিনের বাসিন্দা হতে! ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’ কবির এই অভিপ্রায় কার্যত বাস্তবায়ন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ই পারে মানবজ্ঞানের সম্পূর্ণতা দিতে, পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানের মধ্যে তৈরি করে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন, যা পূর্ব থেকে পশ্চিম, দক্ষিণ থেকে উত্তরকে একাকার করে দেয়। আজকের পৃথিবী যে আলোকের ঝর্ণাধারায় উদ্ভাসিত, তার মূলেও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন বিষয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য বিশেষত, মহাকাশ, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, শিল্পসাহিত্য সর্বক্ষেত্রে পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যগাথা নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে নানান গল্প ও উপকথা।
এখন তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে নামমাত্র নাগরিক সুবিধা নিয়েও সাফল্যের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনন্য উচ্চতায় আরোহণ করতে চায়, সেটি সত্যিই বড় ঘটনা। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মোচন করতে পারিনি সত্যি, কিন্তু আমাদের এমন কোনো ব্যবস্থা প্রবর্তন করা উচিত যাতে করে তাদের দুর্ভোগ লাঘব হয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি ছুটবে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ এখানে পরীক্ষা তো কাল ওখানে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই তাদের দীর্ঘশ্বাসে ছুটতে হবে রাজশাহী অভিমুখে। সেখানে পড়তে হবে নানা ঝক্কিতে, থাকা-খাওয়ার জোগাড় করতে হবে, খরচ হবে মোটা অঙ্কের টাকা। রুটিন অনুযায়ী প্রতিবছর আসে এই দুর্ভোগ। ধরা যাক, ট্রেনের ভেতরে-ছাদে চেপে কোনোমতে শিক্ষার্থীরা ছুটল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে পরীক্ষা শেষ করেই আবার ছুট মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে না হয় তারা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে কিছুটা, কিন্তু ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় তো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। ভর্তি-ইচ্ছু শিক্ষার্থীদের কী অপরিসীম দুর্ভোগে পড়তে হবে, তা চিন্তা করাও কঠিন। তাদের সঙ্গে এই সীমাহীন যুদ্ধে অভিভাবকদেরও সঙ্গী হতে হয়।
আর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কত? ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে অংশ নিতে কী পরিমাণ আর্থিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, সে খবর কি আমরা কেউ রাখছি? এক মাসের বেশি সময় দেশব্যাপী দৌড়ঝাঁপ, থাকা-খাওয়া, এর আগে তো ভর্তি ফরম পূরণ-সংক্রান্ত খরচ থাকছেই।
যেসব পরিবারের আর্থিক সংগতি আছে, তারা হয়তো এই যুদ্ধে উতরে যাবেন; কিন্তু যেসব পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তারা কীভাবে এই দেশ ভ্রমণের খরচ জোগান দেবে? এর আগে আমরা বহুবার শুনেছি, ঘরের খোরাকি ধান বিক্রি করে বাবা তার সন্তানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম ক্রয়ের পয়সা জোগান দিয়েছেন এবং এই ধারা আজও গ্রামগঞ্জে অব্যাহত রয়েছে। তাহলে ওই যদি বাবাকে তার সন্তানকে অন্তত গোটা দশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে হয়, তবে তাকে নিশ্চিতভাবেই সারা বছরের খোরাকি ধান বিক্রি করতে হবে। এ কেমন দুর্ভাগা ব্যবস্থা, এ কেমন ভর্তি পদ্ধতি। এ পদ্ধতির একটি আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।
এসব দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখেই বেশ কিছুদিন ধরে কথাবার্তা চলছে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের। এমন একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে, যেখানে একবার পরীক্ষা দিয়েই রেহাই পাওয়া যাবে, ঘুরে ঘুরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটতে হবে না। এটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির কথা। বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে এই পদ্ধতি চালু আছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমেছে, মা-বাবার দুশ্চিন্তা কমেছে, আর্থিক ক্ষতি কমেছে, সর্বোপরি কমেছে দুর্ভোগও। অথচ এ পদ্ধতির ভালো-মন্দ নিয়েও বিস্তর আলাপ রয়েছে।
সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয়টি আবার হুমকির মুখে পড়ে। সে ক্ষেত্রে কাছাকাছি বিষয়গুলো একসঙ্গে রেখে একটি অভিন্ন গুচ্ছ পদ্ধতি আবিষ্কার এখন সময়ের দাবি। বিষয়টি এভাবে হতে পারে যে, গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের জন্য একজন শিক্ষার্থী একবারই পরীক্ষা দেবে, ফরম পূরণের সময়ে সে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তার পছন্দের তালিকা জানাবে এবং একই সঙ্গে জানাবে যে কোন অঞ্চল থেকে পরীক্ষায় অংশ নেবে। যেমন গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদে ভর্তি-ইচ্ছু কোনো একজন শিক্ষার্থীর পছন্দের তালিকায় ক্রমানুসারে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রামসহ দেশের যেকোনো চারটি বা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে। ধরা যাক যে খুলনা যশোর জেলার বাসিন্দা, এ পদ্ধতির অধীনে সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দিতে পারে, এ ক্ষেত্রে তার পছন্দের তালিকায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নাও থাকতে পারে। এভাবে প্রাপ্ত নম্বর ও শিক্ষার্থীদের দেওয়া পছন্দের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আসন বণ্টন করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমবে, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে তাকে ঢাকায় আসতে হবে না, অন্যদিকে তার পছন্দের স্বাধীনতাও সমুন্নত থাকল। এভাবে একজন শিক্ষার্থীর জন্য দুটি বা তিনটি ইউনিটে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, এতে অহেতুক চাপও কমে আসবে।
একটি সহজতর ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা না গেলে চলমান নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রেসিডেন্ট, রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন।