চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক
পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন যুগের সূচনা
গেল তিন দশকের মধ্যে প্রথম বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর অর্থনীতির দেশ চীনের একজন রাষ্ট্রপতিকে আমরা বাংলাদেশে বরণ করলাম। শি জিনপিং এমন একটা সময়ে বেশকিছু উন্নয়ন ও সহযোগিতা পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশে পা রেখেছেন যখন গোটা বিশ্ব তথা দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো সীমান্ত জটিলতা, জঙ্গি হামলা, এক দেশ অপর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপসহ নানা বিষয়ে মতানৈক্যে ও টানাপড়েনে এক ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে ভারত, জাপান ও আমেরিকা নিজেদের আধিপত্য রক্ষায় যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে এবং অরুণাচল প্রদেশের লাদাখে বিরোধকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে চীন সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে বাড়তি সৈন্য ও ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার গ্রুপ (এনএসজি) তে ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চীনের বিরোধিতা এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে চীনের অনুপ্রবেশ বিতর্কসহ বহ্মপুত্রের পানিবণ্টন নিয়েও ভারত-চীন সম্পর্ক এখন বেশ তিক্তকর অবস্থায় রয়েছে।
তার ওপর কাশ্মীরে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়দের সহযোগিতা জোট সার্কের শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত ভণ্ডুল হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাধর চীনের রাষ্ট্রনায়কের বাংলাদেশ সফর অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ব নেতাদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কতটা; তা অনুধাবন করার এই তো সময়। যেখানে বর্তমান সরকার ভারতের সাথে বাংলাদেশের মিত্রতা বজায় রেখে চলছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতি চীনা প্রেসিডেন্টের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং এখানে তাঁকে সর্বোচ্চ সংবর্ধনায় বরণ করার মধ্যে এক অনন্য গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল বাজারে নিজেদের অমূল্য করে উপস্থাপন করার দায়িত্ব সবার আগে আমাদেরই। শি জিনপিংকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে সেই পথেই তবে আমরা পা রাখতে যাচ্ছি?
ভৌগোলিক কারণেই বিশ্ব পরাশক্তিদের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে। পরিবর্তিত সময়ে নিম্ন মধ্যম আয়ে যে বাংলাদেশ এখন সবার চোখে রোল মডেল। রাজনীতিতে কার্যকর গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দুর্নীতির বিষফোঁড়া ছাড়া সামাজিক অর্থনৈতিক সব সূচকে আমরা এখন প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বেশ এগিয়ে। ৬-এর উপরে ধারাবাহিক জিডিপি আমরা ধরে রেখেছি। কেবল সুশাসন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা গেলে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হতে খুব বেশি দেরি না হওয়ারই কথা।
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’- বঙ্গবন্ধু প্রণীত পররাষ্ট্রনীতির এই মূলমন্ত্রকে আমরা আরো ভিন্নমাত্রা দিতে পেরেছি এভাবে, দেশের স্বার্থে মিত্রের শত্রুরও আমাদের বন্ধু হতে বাধা নেই। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাহায্যকারী বলে ভারতের সাথে বরাবর মিত্রতা রক্ষা করে চলি আমরা। তাদের করিডর দেই, বিদ্যুৎ বা পাইপ লাইনে তাদের দেশ থেকে তেল নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করি, এমনকি সুন্দরবনের ওপর বিরাট চাপ মেনে নিয়েও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণ করতে দেই ভারতকে। এসব দেওয়া-নেওয়ার বিষয়ে দেশের স্বার্থ আগে নাকি ক্ষমতার ভিত রক্ষা করাটা আগে সেসব সমালোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে আমরা ছোট রাষ্ট্র বলে এক রকম বাধ্য হয়েই ভারতীয় আধিপত্যকে আশকারাও দেই। দেশের বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরকে সহ্য করতে না পারার প্রবণতাই নানা ছলছুতোয় আমাদের ওপর ভারতীয় আগ্রাসনের রসদ জুটিয়ে চলেছে।
চীনের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরে ঈর্ষান্বিত হতে পারে ভারত এমন খবর দিয়েছে চীনা মিডিয়া। বাংলাদেশের ওপর ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে রক্ষা পেতে চীনা মিত্রতাকে বেগবান করার ব্যাপারটির গুরুত্ব নিশ্চিত করে এই খবরটিই। যদিও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ভারতের বিক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ দেখেননি। চীন ও ইউরেশিয়ার মধ্যে আঞ্চলিক ও আন্ত আঞ্চলিক সংযোগের সমর্থক ‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ানরোড’ বা ‘এক অঞ্চল, একপথ’ নামে চীন পরিকল্পিত এই উদ্যোগের সাথে ভারতের মতৈক্য হবে এমনটা নাও হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের এখনকার পরমমিত্র ভারতের চক্ষুশূল চীনকে যদি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অংশীদার বা সহযোগী হতে আহ্বান জানাতে পারি- এটাকে শেখ হাসিনা সরকারের সুচতুর কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য করা উচিত নয়। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে আরো বেগবান ও স্থিতিশীল করতে বৃহৎ অর্থনীতি চীনের সাহচর্য আমাদের দরকার। আমাদের চাহিদা মতো ঋণসুবিধাসহ চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকে যদি চীনকে রাজি করাতে পারি তবে তা হতে পারে উত্তর প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ।
বাংলাদেশ সফর নিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, চীন ও বাংলাদেশের জনগণ একসঙ্গে ইয়া লু জান বু চিয়াং নদী তথা যমুনা নদীর পানি খায়। দুই দেশের বন্ধুত্ব সুদীর্ঘকালের। চীন তাদের সংস্কৃতি ও বাংলা সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটাতে,পরস্পরের কাছ থেকে শিখতে এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে মানসিক-সেতু স্থাপন করতে চায়। চীন ও বাংলাদেশের জনগণের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় সুফল অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০০ সালের ৯০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে ১৪৭০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। এ ক্ষেত্রে বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের পাটজাতীয় পণ্যও চীনের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
শি জিনপিং সংবাদ মাধ্যমগুলোকে আরো জানিয়েছেন, চীন ও বাংলাদেশের জনগণ প্রাচীনকাল থেকেই পরস্পরের ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু। প্রাচীনকালের দক্ষিণ রেশমপথ এবং সামুদ্রিক রেশমপথ ছিল দুই পক্ষের যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মূল মাধ্যম। এ নিয়ে হাজার বছর ধরে প্রচলিত অনেক গল্প-কাহিনীও রয়েছে। চীনের ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাং বৌদ্ধধর্মগ্রন্থের সন্ধানে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অতীশ দীপঙ্কর চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছেন। চীনের মিং রাজবংশ আমলের সমুদ্রচারী চাং হো-ও দুবার বাংলা সফর করেন। তিনি লিখেছেন: ‘এ অঞ্চলের রীতিনীতি সরল। এলাকাটি জনবহুল ও শস্যসমৃদ্ধ। এখানকার উর্বর জমিতে প্রচুর ফলন হয়।’ বঙ্গদেশের তৎকালীন রাজা চীনের মিং রাজবংশ আমলের সম্রাটকে একটি জিরাফ উপহার দিয়েছিলেন। তখন ওই জিরাফ চীনে ‘চীনা ড্রাগন ছিলিন’ নামে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
অন্যদিকে শি জিনপিংয়ের সফর নিয়ে চীনা রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শি জিন পিংয়ের এই সফরের ফলে দুই দেশের মধ্যে ‘নিবিড় সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা’ হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন, এজন্য অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্ব বোধ করছেন বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শি জিনপিংয়ের এই সফরকে কূটনীতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাফল্যমণ্ডিত করাটাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ অনেক কম। শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে চীন নেই। তবে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কেবল চীনের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। দ্রুত এ কাজ শেষ হলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে বলে আশা করাই যায়।
শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক মিত্রসহ সবার নজর এখন বাংলাদেশে। সন্দেহ নেই যারা আমাদের নিজেদের স্বার্থে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাখতে চায় তাদের মধ্যে এক ধরনের মাথাব্যথার কারণ হবে এই সফর। তবে খেয়াল রাখা চাই, আমরা এই সুযোগে কারো আধিপত্য বিস্তারের চুক্তিতে যেন স্বাক্ষর করে না বসি। আমরা চাই বাংলাদেশের উন্নয়নের নিখাদ সঙ্গি হোক চীন। চাই ৮৮৪ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দূরীভূত হোক। আমাদের সার্বিক উন্নয়নে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরিত হোক।
আর এর মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় উন্নয়নের সোনালী সাফল্যে চীন বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করুক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন