যুক্তরাষ্ট্র
হিলারির হ্যাটট্রিক ও ট্রাম্পের ট্রামপল
অবশেষে হিলারি হ্যাটট্রিক করলেন। আর ট্রাম্প হলেন ট্রামপল বা ধরাশায়ী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চূড়ান্ত বা সামাপনী বিতর্কে অনেকেরই আশা ছিল চমক আসবে। হিলারি হয়তো প্রথম ও দ্বিতীয়বারের মতো ভালো করতে পারবেন না। তার কারণ ট্রাম্পের ভালো করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা থাকবে। তা ছাড়া অনভিজ্ঞ ট্রাম্প দুটো বিতর্ক থেকে শিখেছেন কিছু। কিন্তু ‘মোটা মস্তিষ্ক’ দ্বারা সৃজনশীলতা যে সম্ভব নয়, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। বিতর্কটি গভীর মনযোগ সহকারে যাঁরা দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, ট্রাম্প বিতর্কের প্রথম দিকে নিজের অস্থির চরিত্রকে স্থির করার সমূহ চেষ্টা করেছেন। কথায় বলে,‘স্বভাব যায় না ম’লে’। ট্রাম্প হিলারির ফাঁদে পা দিয়েছেন।
বিতর্কের শেষের দিকে একটি মন্তব্য এবং আরেকটি নীতিগত সিদ্ধান্ত সবকিছু ওলোট-পালট করে দেয়। কর নীতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে হিলারি বলেন, তাঁর প্রস্তাব অনুসারে মধ্যবিত্তের আয়ের ওপর নতুন কোনো কর আরোপ করা হবে না। তবে অবসর ভাতা বা সামাজিক নিরাপত্তাভুক্ত প্রতিটি নাগরিকের প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ বাড়বে। একথা বলার পার ট্রাম্পের দিকে তাকিয়ে হিলারি মন্তব্য করেন, এমন কি ট্রাম্পের বেলাতেও বাড়বে, অবশ্য তিনি যদি তাঁর ওপর ধার্যকৃত অর্থ না দিয়ে ফসকে যাওয়ার পথ খুঁজে না পান। এ কথায় হিলরির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ট্রাম্প মন্তব্য করেন,‘কী জঘন্য নারী’! (How nasty lady)। আর নীতিগত যে বিষয়টি সবাইকে হতাশ করেছে তা হলো, নির্বাচনে তিনি জয়ী না হলে ফলাফল মেনে না নেওয়ার ঘোষণা। শেষ বিতর্কের আগেও তিনি একই কথা বলেছেন।
লাসভেগাসে নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৯ অক্টোবর দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর মধ্যে তৃতীয় বিতর্কে সঞ্চালক ফক্স নিউজের ক্রিস ওয়েলেস, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরকে মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। ফল মেনে নেওয়া সম্পর্কে ট্রাম্পের জবাবে তিনি এতটা বিস্মিত হয়ে ছিলেন যে, তাকে ভুল শোধরানোর সুযোগ দিতে দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করেন। তখন ট্রাম্প বলেন, ‘আমি আপনাদের রহস্যের মধ্যে রাখব।’ বিতর্কের পরের দিন ২০ অক্টোবর ওহাইও অঙ্গরাজ্যে এক সমাবেশে তিনি একই কথা বলেন। সেখানে তিনি বলেন, ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনি ফলাফল মেনে নেবেন। ফলাফল যদি সুস্পষ্ট হয় তা হলে তিনি আপত্তি করবেন না। তবে ফল যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে তা চ্যালেঞ্জ করার অধিকার তাঁর রয়েছে। ট্রাম্প এত দিন ধরে দাবি করে আসছেন, মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি দুর্নীতিগ্রস্ত। তিনি অভিযোগ করেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন কারচুপির মাধ্যমে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য দেশটির তথ্য মাধ্যম ও বৃহৎ পুঁজি প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ ধরনের মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
রিপাবলিকান নেতাকর্মীরা আশা করে ছিলেন, শেষ বিতর্কে ট্রাম্প ভালো করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে ফিরে আসবেন। বিতর্কের বেশির ভাগ সময়ে তিনি হিলারির সাথে সমান তালে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্বভাবসুলভ ভাবে সবকিছু গুলিয়ে ফেলেন। নির্বাচন বিষয়ে তাঁর মন্তব্যে শীর্ষ রিপাবলিকান নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। মিশেল ওবামা বলেন, ‘তিনি আমাদের গণতন্ত্রকে রহস্যের মধ্যে নিয়ে যেতে পারেন না।’ ২০০৮ সালের রিপাবলিকান প্রার্থী ম্যাককেইনের প্রচার ব্যবস্থাপক স্টিভ স্মিডৎ ফলাফল মানতে ট্রাম্পের অস্বীকৃতির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘বিতর্কে ট্রাম্প যতটুকু ভালো করেছিলেন, এই একটি কথার কারণে তিনি সেই ভালো সবটুকু হারিয়েছেন।’
যা হোক সমাপনী বিতর্ক হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী দর্শকদের আগ্রহ ছিল ব্যাপক। তবে তা প্রথম বিতর্কের মতো বেশি দর্শক আকৃষ্ট করতে পারেনি। মার্কিন ঐতিহ্য অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাৎক্ষণিকভাবে জনমত জরিপ করে। সিএনএন/ওআরসি পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে, হিলারি ক্লিনটন ৫২% এবং ডোনান্ড ট্রাম্প ৩৯% সমর্থন পেয়েছেন। এ ধরনের বিতর্ক ভোটারদের তেমন প্রভাবিত করে না বলে রেকর্ড আছে। যেহেতু নির্বাচন ব্যবস্থা কঠোর দলীয় অবস্থান নির্দেশ করে, এ ধরনের বিতর্ক শুধু দল নিরপেক্ষ ভোটারদের প্রভাবিত করে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অবস্থার নাটকীয় পরিবর্ত না হলে, হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ৯০%।
অবশ্য এই প্রথমবারের মতো নির্বাচন ব্যবস্থায় পেশিশক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প প্রচারণা প্রথম দিকে ‘গান পাওয়ার’ ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে নর্থ ক্যারোলিনায় রিপাবলিকান পার্টির নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলার পর পেশিশক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পর্যবেক্ষরা এটাও আশঙ্কা করছেন যে, মুসলিম ও অভিবাসীবিরোধী ইহুদি লবি জনমত পক্ষে নেওয়ার জন্য সহিংসতা ঘটাতে পারে। তবে আশার কথা মার্কিন সরকার ব্যবস্থা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিগত ২৪০ বছর ধরে সে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে। সাময়িক ব্যতিক্রম এবং ব্যর্থতাকে অকার্যকর করার সক্ষমতা মার্কিন সমাজের রয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়