মার্কিন নির্বাচন
ই-মেইল ফাঁসের বেফাঁস কথা
মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা আগাম মন্তব্য করছিলেন যে অবশেষে ট্রাম্প ‘ট্রাম্পকার্ড’ দেখাতে পারেন। সেটা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক হতে পারে। ইতিবাচক বলতে শেষের দিকে ট্রাম্প আকর্ষণীয় পরিকল্পনা অথবা সুন্দর সুন্দর কথা বলে ভোটারদের মন জয় করতে চাইবেন। অন্যদিকে, নেতিবাচক বলতে পর্যবেক্ষকরা অভিবাসী এবং মুসলিমদের তরফ থেকে ভায়োলেন্স ঘটিয়ে ঘৃণার ফসল তুলতে চাইবেন। কিন্তু না, প্রথমটি ঘটেনি। দ্বিতীয়টি ঘটার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। মাঝখান থেকে ঘটেছে তৃতীয় ঘটনা। সেটা হলো সেই ই-মেইল ফাঁসের কথা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় হিলারি ও তাঁর সহযোগীরা ব্যক্তিগত সার্ভার ব্যবহার করে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় ই-মেইল চালাচালি করেছিলেন—এ অভিযোগ অনেক পুরোনো। হিলারি তাঁর অসাবধানতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন; ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছেন। প্রতিটি সংলাপে ট্রাম্প বিষয়টি উল্লেখ করে হিলারিকে বিব্রত করতে চেয়েছেন। হিলারি বিনয়ের সঙ্গে প্রতিবারই দায় স্বীকার করেছেন। বিষয়টি এভাবেই মীমাংসিত হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু ‘নতুন করে পুরোনো ঘটনা’ প্রকাশিত হলো এই সেদিন।
অকস্মাৎ এফবিআইর প্রধান জেমস কমি কংগ্রেসের কাছে লিখিত এক চিঠিতে জানান, এফবিআই অন্য একটি বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে হিলারি ক্লিনটনের কিছু ই-মেইল সম্পর্কে তাঁরা অবহিত হয়েছেন। জেমস কমি মনে করেন, এসব ই-মেইল হিলারির ই-মেইল-সংক্রান্ত আগের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে দেখা যেতে পারে। ঘটনার উৎসটি এ রকম, হুমা নামের একটি মেয়ে হোয়াইট হাউসে থাকার সময়ে হিলারির চোখে পড়েন। মেয়েটি হিলারির সঙ্গে কয়েক বছর ধরে কাজ করেন। পরে কংগ্রেসম্যান ওয়াইনারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ওয়াইনারের ই-মেইল ধরে গোয়েন্দা সংস্থা হিলারির সংযোগ পায়। সংস্থাটি ওয়াইনার ও হুমা আবেদিনের একটি অভিন্ন কম্পিউটার পরীক্ষা করে। তখনই হিলারির সঙ্গে হুমা আবেদিনের কিছু ই-মেইলের সন্ধান পায় তারা । যদিও নেতিবাচক কিছুই এখনো দৃশ্যমান হয়নি, তার পরও নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে এফবিআইর এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। যদিও হুমা আবেদিন কংগ্রেসম্যান ওয়াইনারের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেছেন, তবুও হিলারিকে ধরার জন্য প্রতিপক্ষ কেঁচো খুঁড়ছে, যদি সাপের সন্ধান পাওয়া যায়! মূলত ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি মেইল হুমা ও ওয়াইনারের সম্পর্কের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওয়াইনারের আরো কেলেঙ্কারি বেরিয়ে আসে।
বিষয়টি হিলারির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। শুধু সংযোগের আশঙ্কা করে এ তদন্তের সিদ্ধান্ত মার্কিন মুলুকে তোলপাড় তোলে। প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, এফবিআই কেন নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে এমন সিদ্ধান্ত নিল, যা সংবেদনশীল মার্কিন ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে। ডেমোক্রেট ফ্রন্ট মনে করে, এটি উদ্দেশ্যমূলক। তাদের সমর্থক একটি সংগঠন এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে জেমস কমির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। ‘যা রটে কিছু না কিছু ঘটে’—এ রকম প্রচারণা দ্বারা ভোটারদের বিভ্রান্ত করা এ তদন্তের লক্ষ্য বলে পর্যাবেক্ষকমহল মনে করে। উল্লেখ্য, এর আগে পরিচালিত ই-মেইলবিষয়ক বিতর্কে হিলারি ক্লিনটনকে ‘বেকসুর খালাস দেওয়া’ হয়। মার্কিন প্রশাসনে ইহুদি লবির প্রাধান্য সম্পর্কে অবহিতরা মনে করেন, এটি তাদের কাজ হতে পারে। মার্কিন আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। বিশিষ্ট সাংবিধানিক আইনবিদ, সিএনএনের আইনবিষয়ক বিশ্লেষক জেফরি টুবিন মন্তব্য করেন, জেমস কমির পদক্ষেপ আইন ও কনভেনশন উভয়কে ভঙ্গ করেছে। এফবিআইর এই পদক্ষেপ নিয়েই তদন্তের দাবি উত্থাপিত হয়েছে।
এদিকে, উইকিলিকস প্রতিদিনই হোয়াইট হাউস-সংক্রান্ত হাজার হাজার গোপন ই-মেইল ফাঁস করছে। যদিও এর অধিকাংশই কোনোরকম বিশেষত্ব বা রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে না, তবুও বিষয়টি মার্কিন নাগরিকদের বিব্রত করছে। তার কারণ, এরা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করে প্রার্থীকে বিব্রত করছে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের গোমর ফাঁস করছে। আরো প্রকাশ করছে উভয় দলের প্রতি করপোরেট হাউসগুলোর লাখ লাখ ডলারের অনুদানের খবর। মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করতে না পারলেও সারা বিশ্বে এ ধরনের গুজব মার্কিন ইমেজের যথেষ্ট ক্ষতি করছে।
ফাঁস ই-মেইল নিয়ে যেসব বেফাঁস কথা বলা হচ্ছে, তাতে কে লাভবান হচ্ছে? রাজনীতিবিমুখ মার্কিন নাগরিক সমাজ এর দ্বারা যে কিছুটা প্রভাবান্বিত হয়েছে, সর্বশেষ জনমত জরিপে ট্রাম্পের অবনতিশীল অবস্থার উন্নতিই তার প্রমাণ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ই-মেইল ফাঁস প্রশ্নে হিলারি ক্লিনটনের অবস্থান অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল। এখন তিনি স্পষ্ট করেই দাবি করছেন, এফবিআইর কাছে এসব বিষয়ে যে তথ্য আছে, তার সবই প্রকাশ করা হোক। এতে সচেতন মার্কিন নাগরিকরা আশ্বস্ত হতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা অস্বচ্ছতাকেই তাঁদের পুঁজি মনে করেন, তাঁরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে পারেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।