মার্কিন নির্বাচন
ক্রমহ্রাসমান ব্যবধান ও ট্রাম্পের অসংলগ্ন সংলাপ
ক্রমশ আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠছে মার্কিন নির্বাচন। আর মাত্র ৫ দিন বাকি। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ও ট্রাম্প শেষ মুহুর্তের প্রচারণা নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত। যে সমস্ত নির্বাচনী রাজ্য অমিমাংসিত সেখানে দুজনেরই প্রাণান্ত প্রয়াস তাদের পক্ষপুটে নিয়ে আসার। জনমত যাচাইয়ে ব্যস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন তাদের জরিপের ফলাফল প্রকাশ করছে। এই প্রচারণা প্রতিষ্ঠানগুলো দু’রকমের। দল ও প্রার্থীর তরফ থেকে একদল প্রচারণা কর্মী এবং ভাড়াটে প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে ফলাফল প্রকাশ করছে। অপরগুলো মোটামুটি নিরপেক্ষ। তারা নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কাজ করে। এই ডামাডোলের মধ্যে আসল-নকল বোঝাই মুশকিল। সর্বশেষ পরিচালিত জরিপে এখনো হিলারি এগিয়ে। তবে ব্যবধান কমে আসছে। চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত জরিপে দেখা যায় যে, ট্রাম্প হিলারির সাথে তাঁর পয়েন্টের ব্যবধান প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন। এ ছাড়া ট্রাম্পের কার্চুপির অভিযোগ প্রচারণা গুণে হালে পানি পেতে শুরু করেছে। জরিপের তথ্য সমন্বয়কারী শিকাগো ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘রিয়াল ক্লিয়ার পলিটিক্স’-এর হিসাব অনুযায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন ৪১.৯% আর হিলারির সমর্থন ৪৮.১% অর্থাৎ এখনো ট্রাম্পের চেয়ে ৬.২ পয়েন্ট পেয়ে এগিয়ে আছেন হিলারি। তবে পূর্বেকার গৃহীত জরিপে ব্যবধান অনেক বেশি ছিল।
মার্কিন নির্বাচনে প্রচারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারণা কৌশল, বিজ্ঞাপন এবং গণমাধ্যম পক্ষে নেয়ার প্রতিযোগিতা চলে। নির্বাচন কেন্দ্র করে অভিযোগের এবং পাল্টা অভিযোগের প্রতিযোগিতা চলে। প্রার্থীদের ব্যক্তিগত জীবণ থেকে অতীতের সবকিছুই আলোচনা- সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাড়ায়। ধনকুবের ট্রাম্প ইতিপূর্বে যে জীবণ অতিবাহিত করেছেন অথবা হিলারি তাঁর কর্ম জীবণ কিভাবে ব্যবহার করেছেন- সব কিছুই প্রচারণায় চলে আসছে। ট্রাম্প হয়তো কখনো ভাবেননি তার সব নারী ঘটিত কেলেংকারির জন্য এতো নাকানি-চুবানি খেতে হতে পারে। হিলারি ব্যক্তিগত ই-মেইল কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেন কোথায় যোগাযোগ করলেন সেটিও এখন বিবেচ্য বিষয়। প্রচারণা করতে গিয়ে যে মিথ্যাচারের ব্যবহার হয় না তা নয়। তবে তা অল্প সময়ের জন্য। মিথ্যা প্রমাণিত হলে আবার গণেশ উল্টে যায়। এবারে উভয় পক্ষে প্রচারণা তুঙ্গে পৌছেছে। হিলারি পক্ষ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অসততা এবং নারী কেলেংকারীর মতো বিষয় প্রচারণা চালাচ্ছে। হিলারি বলেছেন, ‘ট্রাম্প নিজেই তার অযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।’ আর ট্রাম্পের তরফ থেকে হিলারির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং অদক্ষতার অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে। ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন, ‘হিলারি বিজয়ী হলে তিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিবেন।’ সর্বশেষ প্রচারণায় হিলারি ট্রাম্পকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদের অনপযুক্ত এবং অযাচিত বলে উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্প তার কথিত ‘ন্যাস্টি ল্যাডি’কে অনুরূপ ভাষায় আক্রমণ করছেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারীর অভিযোগ অনেকটা থিতিয়ে গেছে। তবে ট্রাম্প নিজেই বিরোধী শিবিরকে নানা ধরণের আক্রমণের অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন।
ট্রাম্প প্রচারণায় অনেকটা তৃতীয় বিশ্বের ম্যাকানিজম চালু করেছে। যেমন ট্রাম্প দাবী করছেন তাকে ভোট গ্রহণ ছাড়াই বিজয়ী ঘোষণা করা হোক। আবার তিনি বলছেন নির্বাচন ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। তিনি নির্বাচন প্রত্যাখানের আগাম ঘোষণা দিচ্ছেন। তৃতীয় বিশ্বের অনুসরণে মাস্তান সংস্কৃতি আমদানির চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে হিলারির প্রচারণা ক্যাম্প আক্রান্ত হয়েছে। নির্বাচনের দিন তার লোকেরা গোন্ডগোলের আভাস দিচ্ছেন। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের একজন শক্তিশালী সমর্থক সাবেক কংগ্রেসম্যান ওয়ালশ টুইটারে লিখেছেন, ‘যদি ট্রাম্প হেরে যান, তবে আমি আমার অস্ত্র হাতে নামছি। আপনি কী আসছেন?’ তবে সুশীল সমাজ এ ধরণের সহিংসতার প্রতিবাদ করছেন। ঐ টুইটের নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক এর প্রধান ড্যান গ্রস বলছেন, ‘আমাদের রাজনীতি পরিবেশে এ ধরণের সহিংসতার কোন স্থান নেই।’ তিনি জয়ী না হলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য তিনি নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ট্রাম্প বলছেন, জরিপে কান দিবেন না। আমিই জিতবো। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন কোন রাজ্যে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। জাল ভোট দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছেন টেরিলিং রোড নামের একজন সমর্থক। সে বলেছে, ‘কারচুপি হবেই মনে করে তিনি নিজেও জাল ভোট দিতে গিয়েছিলেন।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবারের মতো খারাপ পরিবেশ আর কখনো দেখা যায়নি বলে পর্যবেক্ষকরা মন্তব্য করছেন। তারা একে অপরকে অসংযত ভাষায় আক্রমণ করছেন। ট্রাম্প হিলারিকে ‘ন্যাস্টি ল্যাডি’ বলে মহিলাদের কাছে নিজেই ‘ন্যাস্টি’ হয়েছেন। প্রচারণায় যে সংযম, সহনশীলতা ও সৌজন্য আগের সব প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লক্ষ্য করা গেছে এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটছে। ধর্মনিরপক্ষেতার উচ্চ মার্গের দাবীদাররা সেখানে ধর্মকেও টেনে আনছেন। হিলারি মুসলিমদের টানছেন। তিনি তার নির্বাচনী সন্মেলনে একজন পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মুসলিমকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। খিজির খান নামের এই মুসলিমের এক ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। ট্রাম্প তাকে নিয়ে অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করেছেন। অপরদিকে খিজির খান হিলারির পক্ষে একটি নির্বাচনী বিজ্ঞাপনেও অংশ নিয়েছেন। ট্রাম্পের মুসলিম বিরোধী মনোভাব মার্কিন মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তার এই বিরুদ্ধ মনোভাব তাকে আমেরিকান হিন্দুদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। ‘হিন্দুজ ফর ডোনাল্ড ট্রাম্প’ নামে একটি ফেসবুক পাতা খোলা হয়েছে। এতে পদ্মাসনে সমাসীন ট্রাম্পের একটি ছবি রয়েছে। ট্রাম্প হিন্দু মন্দিরের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন।
একটি বিজ্ঞাপন চিত্রে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি হিন্দুদের ভালোবাসি।’ ট্রাম্পের এ নতুন বিজ্ঞাপন চিত্রটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি এবং প্রতীকি মুসলিম জঙ্গির আদল দেখানো হয়। তবে সংখ্যার কথা হিসেবে আনলে হিন্দু-মুসলিম এর এই লড়াইয়ে হিলারিই অধিক লাভবান। আমেরিকায় মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। অন্যদিকে হিন্দুদের সংখ্যা ১ ভাগেরও কম। ট্রাম্পের সহিংস মনোভাবের বিপরীতে সাধারণ মার্কিনীদের মধ্যে তার প্রতি ঘৃণাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হলিউডে একজন সাধারণ আমেরিকান ডোনাল্ডের মূর্তিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
আর মাত্র ৫ দিনের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব, কর্তৃত্বের সুরাহা হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে মার্কিনীরা যতটানা ক্লান্ত তার চেয়ে বেশি অবসন্ন। আগেই বলা হয়েছে সামগ্রিকভাবে মার্কিন জনগণ রাজনীতি বিমুখ। খবর বেড়িয়েছে জনগণ আর প্রচারণা ভার বইতে চাইছে না। সব সময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সাথে সাথে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের খালি আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেই সাথে কিছু আইনগত এবং জনমত যাচাইয়ের বিষয় সংশ্লিষ্ট থাকে। যেমন- এবারের নির্বাচনে কোন কোন রাজ্যে স্বেচ্ছা মৃত্যু, মৃত্যুদণ্ড, গাঁজা সেবন এবং পশুপাখি শিকারের মতো বিষয়ে জনমত যাচাই করা হবে।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি নানা কারণেই ভিন্ন ধর্মী। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দু’জন প্রার্থীর দু’ধরণের সমীকরণ রয়েছে। ট্রাম্পের সহিংস মন্তব্য বিদেশেও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তার সহিংসতামূলক বক্তব্য বহির্বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাই পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন হিলারি নির্বাচিত না হলে মার্কিন গণতন্ত্র হুমকির সন্মুখীন হবে। বহির্বিশ্বে এর রাজনৈতিক ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।