বিশ্ব টেলিভিশন দিবস
টিভির বিনোদন, টিভির স্বাধীনতা
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/11/21/photo-1479727109.jpg)
আধুনিক গণমাধ্যম ও বিনোদনের আধার হিসেবে পরিগণিত ‘দূরদর্শন’ বা ‘টেলিভিশনে’র আজ জন্মদিন। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২১ নভেম্বরকে বিশ্ব টেলিভিশন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯২৬ সালের আজকের এই দিনে স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড (১৩ আগস্ট ১৩, ১৮৮৮- ১৪ জুন ১৯৪৬) টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। সনাতন সেই এনালগ টেলিভিশনের যুগ পেরিয়ে ৯০ বছর পর আমরা এখন আলট্রা হাই ডেফিনিশনের যুগে প্রবেশ করেছি। ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার সহজলভ্য হলেও টেলিভিশনের আবেদন কমেনি এতটুকু। বরং টেলিভিশনগুলোতে নেট বা কম্পিউটারের সব সেবা একীভূত করা হচ্ছে। তাই বর্তমানে টেলিভিশন হয়ে উঠেছে তথ্য প্রবাহ, বিনোদন বা জ্ঞানান্বেষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
টেলিভিশনের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। ১৮৯৫ সালে বিজ্ঞানী মার্কনি একটি যন্ত্র তৈরি করেন যা ২.৪ কি.মি. দূর পর্যন্ত তরঙ্গ পাঠাতে পারত। পরে ১৯০০ সালে মার্কনি রেডিওর পেটেন্ট করে নেন। রেডিওর মাধ্যমে কথা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলো দূর থেকে দূরে। মানব সভ্যতার প্রথম বিস্ময়কর যন্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হলো রেডিও। এর সমসাময়িক গবেষণাটি আরো বিস্ময়কর। বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যত্র ছবি বা ছবি ও শব্দ প্রেরণ। ১৮৬২ সালে তারের মাধ্যমে প্রথম স্থির ছবি পাঠাতে সক্ষম হন বিজ্ঞানীরা। এই পথ ধরে বিজ্ঞানী মে ও স্মিথ বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে ছবি পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৮৮৪ সালে ২৩ বছরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিপকো ধারণা করেন যে, ভিডিও সিগনাল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো সম্ভব। নিপকোর এই গবেষণার পথ ধরে জন লোগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সালে প্রথম সাদা-কালো ছবি দূরে বৈদ্যুতিক সম্প্রচারে পাঠাতে সক্ষম হন এবং প্রথম আবিষ্কার করেন ‘টেলিভিশন’।
যদিও ভিডিও ও শব্দ একসাথে প্রেরণের কৃতিত্ব ফিলু ফার্নসওর্থ নামের এক মার্কিন বিজ্ঞানীর। এরপর রুশ বংশোদ্ভুত প্রকৌশলী আইজাক শোয়েনবার্গের কৃতিত্বে ১৯৩৬ সালে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু করে বিবিসি। এরই ধারাবাহিকতায় এক দশকের মধ্যে প্রভাবশালী গণমাধ্যমের স্থান দখল করে নেয় টেলিভিশন।
আমাদের এই অঞ্চলে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে টেলিভিশনের সংবাদ ও বিনোদন সেবা পান দর্শকরা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন সংস্থা বিটিভি নামে তাদের নতুন সম্প্রচার শুরু করে। ১৯৮০ সাল থেকে সাদা-কালো যুগ পেরিয়ে রঙিন সম্প্রচারে পা রাখে বিটিভি। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর সময়ের চাহিদাকে মাথায় রেখে বাংলাদেশে এখন সরকারি তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাথে পাল্লা দিয়ে ২৬টি বেসরকারি চ্যানেলও দাপটের সাথে তাদের সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি টিভি চ্যানেল ৩টি। এগুলো হলো- বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড এবং সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন। অন্যদিকে লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৪১টি। এর মধ্যে সম্প্রচার চলছে ২৬টির। এরমধ্যে সম্প্রচারে থাকা এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, এনটিভি, আরটিভি, বাংলাভিশন, একুশে টেলিভিশন, মাছরাঙা টেলিভিশন, দেশ টিভি, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, এটিএন নিউজ, সময় টিভি, জিটিভি, চ্যানেল নাইন, একাত্তর টিভি, চ্যানেল২৪, এসএ টিভি, যমুনা টিভি অগ্রগণ্য। সম্প্রচারে আসার প্রক্রিয়ায় আছে ১৩টি চ্যানেল।
এসবের বাইরে ১৩৮টি ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশন বা অনলাইন টেলিভিশনের আবেদনও তথ্য মন্ত্রণালয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
২৪ ঘণ্টা বিরামহীন সম্প্রচারে থেকে টেলিভিশন আমাদের দেশি-বিদেশি খবরাখবর দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক উত্থান-পতন, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পর্যটন-ভ্রমণ, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য, অপরাধ-বিচার, খেলাধুলা, বিনোদন, চলচ্চিত্র বিষয়ক নানা বিষয় উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শক শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক চেতনায় সব মত ও পথ নির্বিশেষে অন্যের মতের ওপর শ্রদ্ধা রেখে নিজের লব্ধ জ্ঞানকে সাধারণ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়- তা চর্চার উদাহরণ হয়ে উঠছে টেলিভিশনগুলো। আর রিমোটটা দর্শকের হাতে বলে টেলিভিশন থেকে তার ইচ্ছাধীন অনুষ্ঠান গ্রহণে সে পুরোমাত্রায় স্বাধীন।
আজকাল টেলিভিশনের গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে টেলিভিশন ও মিডিয়া স্টাডিজ নামে বিভাগও চালু করা হচ্ছে। গল্প উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের মূল থিম হিসেবেও ‘টেলিভিশন’ বাদ যাচ্ছে না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় টেলিভিশনের গুরুত্ব কতটা- এসবই তার বড় প্রমাণ।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশনের অনুমোদন দেওয়ার পর নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাদের সম্প্রচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ভারতীয় মিডিয়ার আগ্রাসন অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নানামুখী বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেও এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের টেলিভিশন মিডিয়া। এর গ্রহণযোগ্যতার কথা মাথায় রেখে অধিক সংখ্যক দর্শকের কাছাকাছি নিজেদের সেবা পৌঁছে দিতে নিজেদের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি প্রচলিত সোশ্যাল মিডিয়া ইউটিউব, ফেসবুক বা টুইটারের মাধ্যমেও সম্প্রচার সচল রাখছে টেলিভিশনগুলো। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে টেলিভিশনকে এখন আর ‘বোকা বাক্স’ বা ‘ইরেজ মিডিয়া’ বলে তাচ্ছিল্য করবার সুযোগ নেই। কারণ টেলিভিশনে যা কিছু ব্রডকাস্ট হচ্ছে- তার প্রায় সব কপিই দর্শক শ্রোতারা নিমিষে হাতের মুঠোয় থাকা নিজের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ-ট্যাবে পেয়ে যাচ্ছে এমনকি নিজের সংগ্রহেও রেখে দিতে পারছে।
দর্শক মহলে অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের টেলিভিশনে মানসম্পন্ন অনুষ্ঠানের কমতি বলেই তারা দেশি চ্যানেল বিমুখ হয়ে বিদেশি চ্যানেলে নজর দেয়। জেনে বুঝেও বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন মেনে নেয়। এ অবস্থা উত্তরণে একটাই পথ। আরো গঠনমূলক, আধুনিক মানসম্পন্ন ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাপ্রসূত অনুষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে দর্শকের বিদেশ নির্ভরতা কাটানো যেতে পারে। ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবীর কোনো দেশের মিডিয়াই বন্ধ করে রাখবার এতটুকু সুযোগ নেই।
আরেকটু বড় অভিযোগ হলো, প্রযুক্তি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মননে যখন দেশ-বিদেশের সবকিছু এগিয়ে যায়, সেসময় আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সংস্থা বিটিভি থাকতে পছন্দ করে মান্ধাতার আমলেই। এখন পর্যন্ত দেশে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পাওয়া ঘটনা ঘটবার দিনেও বিটিভি থাকে তার চিরাচরিত সরকারি বন্দনায়। এ কারণেই ঐতিহ্যবাহী টেরিস্ট্রিয়াল টিভি স্টেশন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ সরকার যদি বিটিভির ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে এটি বিস্ময়কর সব কাজ করতে পারত। কারণ বিটিভির মতো অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধা আর কোনো টিভি চ্যানেলের নেই।
বিশ্ব টেলিভিশন দিবসে আমাদের চাওয়া একটাই- দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাজাত্যবোধের চেতনায় সম্পূর্ণ স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে গড়ে ওঠুক এবং মত প্রকাশের নিরপেক্ষ পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠে অধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যাক বাংলাদেশের টেলিভিশন। আমাদের মননশীলতায় বেঁচে থাকুক টেলিভিশন।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন