প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ শান্তিতে এগিয়ে, স্বস্তিতে?
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শান্তিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ভুটান ও নেপাল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। সম্প্রতি এক জরিপের এমন ফল প্রকাশ করে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ রয়েছে মোটামুটি বা মাঝারি রকমের শান্ত দেশের তালিকায়। শান্তির নিরিখে ভারতের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে দেশটি। ২০১৬-এর বিশ্বশান্তি সূচকে ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস’ (আইইপি) নিয়মিতভাবে গবেষণা, সমীক্ষা বা চর্চা চালায় সারা বিশ্বে। শুধু রাষ্ট্রপুঞ্জই নয়, আরো অনেক সামনের সারির বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে আইইপি।
নিয়মিত প্রকাশ করে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স বা বিশ্বশান্তি সূচক। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিকেন্দ্রিক এই সংস্থার গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৬-তে ১৬২টি দেশের তালিকা প্রকাশ হয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, পাকিস্তান অতি বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। সূচক অনুযায়ী ভুটান রয়েছে ১৩ নম্বর স্থানে। নেপাল ৭৮ নম্বরে। আর ১৫৩তম স্থানে থাকা পাকিস্তান শান্তি ও স্থিতিশীলতার দিক থেকে খুবই খারাপ অবস্থায়। তবে পাকিস্তানের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আফগানিস্তানের। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির অবস্থান ১৬০তম, যার পরেই রয়েছে সূচক অনুযায়ী সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির দেশ ইরাক। হিংসা, হত্যা, অসামরিক নাগরিকের হাতে অস্ত্র, দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ ২১টি বিষয় মূল্যায়ন করে ওই র্যাংকিং করা হয়। শান্তি ও নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দ্বন্দ্বের সঙ্গে সন্ত্রাসী তৎপরতাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ১৬২ দেশকে নিয়ে সূচক তৈরি করার ক্ষেত্রে। এরই সঙ্গে দেশগুলোর মধ্যে বেড়ে চলা অস্থিরতা সেসব দেশের অর্থনীতির ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, তা-ও বিবেচনায় আনা হয়েছে।
তবে বিস্মিত হলাম, মিয়ানমারে শান্তি আছে বিষয়টি শুনে। যেখানে হাজার হাজার মুসলমান নাগরিক বাস্তুহারা। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা একটু আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। এমনকি হাজার হাজার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি তুলেছে, অং সান সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সূচকটা দেখে একটু দোলাচলে ছিলাম। বাংলাদেশে শান্তি আছে? কিন্তু স্বস্তি কই। বিশেষ করে গেল কয়েক মাসে যা ঘটছে, তা অন্তত স্বস্তির বলা যায় না। গাইবান্ধার সাঁওতালপল্লী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনায় যা ঘটেছে, তা হয়তো প্রকাশ পাচ্ছে না। ১৯৭১ সালে যারা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করেছিল, তারা ছিল বিদেশি, দখলদার আর রাজাকার। আর আজ যারা ঝঁপিয়ে পড়ছে, তারা দেশি দানব। কবি আবুল হাসান লিখেছেন, ‘দালাল উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি।’ তার মানে এখন যেটা হচ্ছে, সেটাও রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে। শাসক যদি শোষক হয়, তাহলে শান্তি কোথায়?
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা এ অঞ্চলে শান্তি এবং স্বস্তি খুঁজে পাব না । এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন অনেক আগে থেকেই। যেটিকে কাজে লাগিয়েছিল ব্রিটিশরাও। ১৯০৬ সালে তাদের মদদে সৃষ্টি হলো দুটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট বাংলার মুসলিম লীগের প্ররোচনায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের সরাসরি উদ্যোগে ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, যাতে অনেক হিন্দু নাগরিক নিহত হন। কিন্তু তখন বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানরাও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সে সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং কমিউনিস্ট পার্টির আলী আকসাদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ভারত বিরোধিতা থেকে হিন্দু বিরোধিতা যোগ হয় এ দেশের মানুষের মধ্যে। যাঁরা ওই সময় দেশের বাইরে ছিলেন, তাঁদের সম্পত্তি রাষ্ট্র নিয়ে নেয়। সে সম্পত্তির নাম দেওয়া হয় এনিমি প্রপার্টি বা ‘শত্রুসম্পত্তি’। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সে সময়ে শান্তি ব্যাহত হয়।
এর মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু হত্যা, মিরপুর পলিটেকনিকের ছাত্র ইউনিয়নকর্মী আফসান হত্যা, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের শিশু, চিকিৎসক নার্গিস, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিসা এমন আরো কত নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতার নাম। যদিও দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘হাইব্রিড’ নেতারাই এসব ঘটাচ্ছে। তাহলে এই হাইব্রিডদের ছেঁটে ফেলা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাহলেই হয়তো গ্লোবাল পিসের শান্তির সূচকে এগিয়ে থাকাটা সার্থক হবে। শান্তির সঙ্গে স্বস্তি যুক্ত না হলে সূচকে হয়তো আগামীতে আমরা পিছিয়ে পড়ব, যেটা একটা শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে চাইছিল বাংলাদেশ পাকিস্তান বা আফগান হোক। যেটা আমাদের জন্য মোটেই শান্তির বা স্বস্তির হবে না।
শান্তনু চৌধুরী : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক