শ্রদ্ধা
মুক্তির দীপ জ্বেলে কাস্ত্রোর মহাপ্রয়াণ
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/11/26/photo-1480144316.jpg)
তাঁর মনকাড়া দুর্গ আক্রমণের কথা আমার মনে আসে না, বিপ্লব কিংবা রক্তপাতের সাফল্য-ব্যর্থতার চেয়েও অনেক বড় একটা অর্জন আছে ফিদেল কাস্ত্রোর। সেটা ভালোবাসার।
২০০০ সালে একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন তিনি, জাতিসংঘের সহস্রাব্দ সম্মেলনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। কথা বলার সময় পেয়েছিলেন পাঁচ মিনিট। কথা বলতে তিনি বড় ভালোবাসতেন।
সেবার কাস্ত্রো হার্লেমে একটা বক্তৃতা দিলেন: দুনিয়ার সম্পদের সাথে দুনিয়ার সংকটের চেহারা নিয়ে। মানুষের সম্ভাবনা নিয়ে। ফিদেলের সেই বক্তৃতারই একটা অংশ বারংবার মনে পড়ে। সংকটের মুহূর্তেও কীভাবে বিশ্বাস আর ভালোবাসার শক্তিটাকে অটুট রাখা যায়, তার একটা শিক্ষা সেখানে আছে।
ফিদেল বলছিলেন, তাঁর ঠিক ১০ বছরের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ের কথা। সোভিয়েত ই্উনিয়নের সাথে বেশির ভাগ ব্যবসা ছিল কিউবার, চিনির বদলে তারা পেতেন ওষুধ, খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী। মার্কিন অবরোধের কারণে বাকি দুনিয়ার সাথে কিউবার ব্যবসা বন্ধ ছিল।
সোভিয়েত পতনে কিউবার দৈনিক মাথাপিছু ৩০০০ ক্যালরি গ্রহণে পতন এলো, রাতারাতি এ হাজার ৮০০ ক্যালরিতে নেমে এলো তা। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে উল্লাস: মানুষ এইবার কাস্ত্রোকে খেদিয়ে দেবে।
কিন্তু কিউবা যা করল তা অবিশ্বাস্য: তারা গোটা দেশের মানুষকে জানিয়ে দিল তাদের কী আছে, কী নেই। মাথা পিছু সম্পদ ভাগ করে দেওয়া হলো জেলা থানা এলাকা পাড়া হিসেবে। সবাই জানল আমাদের কতটুকু আটা আছে, কতটুকু বিয়ার। কতটুকু দুধ আর কতটুকু জ্বালানি তেল। তারা সবাই মিলে উপোস করল, সবাই মিলে বাড়তি পথটুকু হেঁটে গণপরিবহনে চড়ল। শিশুদের দুধের বরাদ্দ কমল না। কমল না হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা। সব বিদ্যালয় একদম একই রকম চালু থাকল। সবাই মিলেই কিউবাকে আবার তুলে ধরল, খাদ্যের উৎপাদন বাড়াল, রাসায়নিক সারের বিকল্প আবিষ্কার করল, ওষুধ আর চিকিৎসাতে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেওয়া অব্যাহত রাখল। গণিত আর বিজ্ঞানে তাদের শিক্ষা পদ্ধতির প্রশংসা জুটল শত্রু শিবির থেকেও। ১০ বছর পর, কাস্ত্রো জানিয়েছিলেন কিউবার মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণ দাঁড়িয়েছিল দুই হাজার ৪০০ তে।
এই সময়ে চলছিল দক্ষিণপূর্ব এশীয় মন্দা। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সম্পদশালী দেশ তখন তার সামাজিক সুবিধা কমিয়ে দিয়েছিল, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বয়স্কদের জন্য সুবিধা নাই হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কারণ ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্র আর উচ্চশ্রেণির স্বার্থ যথাসম্ভব বাঁচিয়েই বিপদটা চাপিয়ে দেওয়া হয় দরিদ্রতর অংশের ওপর। যাইহোক, নিজের দেশে কাস্ত্রো দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সংকটের শিকার যেকোনো জাতি হতে পারে। কিন্তু যদি দেশটা চালানো হয় আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, তাহলে আমলারা নিজেদের সব কিছু অটুট রেখে, ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে বাড়তি কিছু মুনাফাও কামিয়ে সংকট অতিক্রম করবে জনগণের কাঁধে চেপে। আর, দরিদ্র কিংবা সম্পদহীন একটা দেশও মানুষের ওপর ভালোবাসা আর আস্থায় ভর করে সবাই মিলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই— বলা উচিত উচ্চতর একটা গণতন্ত্রের পথেই— সংকটকে মোকাবিলা করতে পারে। মানুষের প্রতি এই ভালোবাসাই কাস্ত্রোকে মহান করেছে, কিউবার মতো ক্ষুদ্র একটি দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপানা, মানব সম্পদের উন্নয়ন নিয়ে স্বেচ্ছান্ধই কেবল চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারে।
কাস্ত্রোর বক্তৃতার কিছু অংশ পড়ে—কিংবা হয়তো অনেক জায়গার টুকরো টুকরো অংশ মিলিয়ে আমরা বুঝতে শিখি এত সামান্য সামরিক শক্তির একটা দেশ কোন জাদুমন্ত্রে দশকের পর দশক ধরে মার্কিন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে টিকে গেল। এই শক্তি মানুষের ভালোবাসার। তাই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সব অবরোধ আর ষড়যন্ত্র থেকে।
মাঝেমধ্যে ভাবি, এই অবরোধ না থাকলে কিউবা নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু করতে পারত, আরো মহান কোনো দৃষ্টান্ত রাখতে পারত। আবার মনে হয়, এই প্রতিবন্ধকতাই তাঁকে তাঁর যাবতীয় মহত্বের মুকুটটাও পরিয়ে দিয়েছে। প্রতিটা সংকট পাড়ি দিতে কিউবা আবিষ্কার করেছে নতুন প্রযুক্তি শুধু না, নতুন সামাজিক সম্পর্কও। গণতন্ত্রের মানে যে শুধু ভোট নয়, সম্পদের ওপর অধিকারও, সেই সত্যটাও আমরা নতুন করে শিখি কাস্ত্রোর কাছে।
কিউবার স্বপ্নবৃক্ষ যদি শুকিয়েও যায় বিরূপতম সময়ে, অজস্র নতুন আলোড়নের বীজ সে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়। বিদায় কাস্ত্রো। তোমাকে অভিবাদন। তোমাকে ভালোবাসা। ‘এই পথে আলো জ্বেলে, এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।’
লেখক : সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন