দৃষ্টিপাত
আন্দোলনের পাওনা শিক্ষকের লাশ
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/11/30/photo-1480488231.jpg)
আমাদের এবার সত্যি সত্যি মেনে নিতে হচ্ছে যে, শিক্ষকরা বড় বেশি অজ্ঞান। তা না হলে রাষ্ট্রঘোষিত জাতীয়করণের দাবি আদায়ে ন্যায্য আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের পিটুনি খেয়ে মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষককে অকাতরে জীবন দিতে হতো না।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ ও স্কুল নেই সেখানে একটি করে বেসরকারি স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ করা হবে। এ উপলক্ষে একটা নীতিমালা করে সরকারীকরণের মাপকাঠিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেসব কলেজশিক্ষকের যোগ্যতা, শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, ফলাফল ও অবকাঠামোর দিক দিয়ে এগিয়ে থাকবে তারাই জাতীয়করণের আওতায় আসবে।
কিন্তু দেশের অপরাপর এলাকার মতো ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। শুধু নাম বিবেচনায় ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ফুলবাড়ীয়া কলেজকে বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজকে জাতীয়করণের আওতায় নেওয়া হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এমন অন্যায্য সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছে ফুলবাড়ীয়া কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এবং এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। আর সবার সম্মিলিত ৪৩ দিনের আন্দোলনের করুণ প্রাপ্তি হলো পুলিশ বাহিনীর চরম অমানবিকতা, বর্বরতা ও শিক্ষক হত্যা।
ফুলবাড়ীয়া কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতা আবুল হাশেম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে ২৫টি কলেজকে সরকারীকরণের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই তালিকায় ফুলবাড়ীয়া কলেজ সরকারীকরণের ৬ নম্বর স্থানে ছিল। অথচ প্রতিষ্ঠার সাত বছরেও এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি এমন একটি কলেজ সরকারীকরণ করা হয়েছে। এমন অন্যায় আমরা কখনই মেনে নেব না। তাই আমরা আন্দোলন করছি’।
জানা যায়, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদানে ফুলবাড়ীয়া কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধু সরকারের শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭৩ সালে কলেজের ভবন উদ্বোধন করেন। উপজেলার বৃহৎ এই বিদ্যাপীঠে বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী রয়েছে পাঁচ হাজার এবং শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন ১৭৫ জন। অন্যদিকে সরকারীকরণের তালিকায় থাকা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালে। যার শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ৩৪৩ জন।
ঠিক ফুলবাড়ীয়ার মতো করেই সর্বশেষ দুই শতাধিক কলেজ-স্কুল জাতীয়করণে অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নামসর্বস্ব ও অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্তির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রভাবশালী অসাধু সিন্ডিকেট ও কর্মকর্তাদের অবৈধ লেনদেনের জোরে ঐতিহ্যবাহী নামি কলেজকে বাদ দিয়ে অন্তত ৫০টি উপজেলায় অযোগ্য, মানহীন, বিতর্কিত কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। যার ফলে অনিয়মের অভিযোগ এনে আন্দোলনে নেমেছেন এলাকাবাসী। ফুলবাড়ীয়ার মতো এমন অসন্তোষ এখন অনেকে এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, নামসর্বস্ব কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা যোগসাজশ করে স্কুল-কলেজ সরকারীকরণকে একধরনের বাণিজ্যে পরিণত করেছেন। এরই মধ্যে নানা অব্যস্থাপনা ও দুর্বল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক হাল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তার ওপর জাতীয়করণ নিয়ে চলমান জটিলতা শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয় ডাকা ছাড়া আর কিছু বয়ে আনতে পারবে না।
জাতীয়করণ নিয়ে এযাবৎকালের সবচে বড় ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে গেল ২৭ নভেম্বরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায়। ফুলবাড়ীয়া কলেজের আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন যা করেছে তা চরম বাড়াবাড়ি। যার যা পাওনা তিনি যদি তা থেকে বঞ্চিত হন, সে বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো যাবে না; এমন কথা আমাদের সংবিধান কেন পৃথিবীর কোনো সংবিধানেই কি লেখা আছে? উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদকে রীতিমতো পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগটা পর্যন্ত না দিয়ে ১৪৪ ধারার অপপ্রয়োগ করে পুলিশি প্রহরায় দাফনও সম্পন্ন করা হয়েছে। তাদের কি কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটা জানা আছে?
যে কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি স্থানীয় সাংসদ মোসলেম উদ্দিন; চুয়াল্লিশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত সেই অনার্স কলেজকে বাদ দিয়ে মাত্র সাত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজকে সরকারীকরণের আওতায় আনা হয়েছে; যে কলেজের মালিক ওই সাংসদপুত্র এমদাদুল হক সেলিম। জাতীয়করণের সব মানদণ্ড পরাভূত হয়েছে কেবলমাত্র বদলে দেওয়া ওই নামের কাছে। এভাবে আর কতদিন কোনো বাছবিচার ছাড়া সবকিছু নামেই আসবে-যাবে?
কিন্তু কলেজের ভেতরে ঢুকে সমাজের বিবেক শিক্ষক ও একজন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে পিটিয়ে মারার অনুমোদন তাদের কে দিল? রাষ্ট্র কি কোনোদিনও তাদের হদিস পাবে অথবা পেতে চাইবে? ঘটনার পর নামকাওয়াস্তে বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা জানি, ওই তদন্ত প্রতিবেদন কোনোদিন আলোর মুখ দেখবে না।
ফুলবাড়ীয়ার অভিযানের ক্ষেত্রে বরাবরের মতোই পুলিশ সাফাই গেয়েছে, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করতে মিছিলে বাধা দিয়েছে পুলিশ। আর শিক্ষকের মৃত্যু বিষয়ে সাফাইটা আরো মর্মান্তিক; ওই শিক্ষক নাকি হার্টের রোগী ছিলেন।
আমাদের চাওয়াটা খুব সোজাসাপ্টা। সবার আগে শিক্ষক ও একজন সাধারণ মানুষ হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হোক। প্রাণের কোনো মূল্য হয় না, তবু পরিবারের স্বজনদের সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে যথার্থ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। ঘটনার সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট নন, এমন নিরপেক্ষ আধিকারিকদের দিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হোক। আর অবিলম্বে সরকারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ফুলবাড়ীয়া কলেজকে সরকারীকরণের আওতায় আনা হোক। দেশের সব শিক্ষাঙ্গনে ফিরে আসুক স্থিতিশীলতা, শিক্ষাটা পণ্য না হয়ে অধিকার হোক আর মর্যাদায় বাঁচুক বাংলাদেশের শিক্ষক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন