পাঠকের কলাম
নাফ নদে গড়াগড়ি খায় মানবতা
নাফ নদের মিয়ানমার অংশে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ১০ মাসের ছোট্ট শিশু। নাম তার তৌহিদ। প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত পার হতে চেয়েছিল এই নিষ্পাপ শিশুটি। কিন্তু তাকে একেবারে না-ফেরার দেশেই চলে যেতে হলো। কেন তাকে চলে যেতে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর তার বোঝার বয়স হয়নি। কেন তার বাবা-মা, ভাইবোনদেরও বেঁচে থাকার অধিকার নেই, সে কারণ জানার সুযোগ সে পায়নি। তার নিজেকেও কেন ওরা বাঁচতে দিল না, তা-ও সে জানার সুযোগ পায়নি। ১০ মাসের ছোট্ট শিশু আর কী-ই বা বোঝে! তবু তাকে চলে যেতে হলো। পার হয়ে বাংলাদেশ অংশে নিরাপদ আশ্রয় নিতে চেয়েছিল শিশুটি। হ্যাঁ, সে পার হয়েছে। তবে নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশের পারে আসতে পারেনি। পার হয়ে মরণের পারে গিয়ে উঠেছে সে। এখন সে খুব নিরাপদ। মায়ের সামনে ঘরের মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে খেলা করার বদলে সারাক্ষণ তার আর অন্তত বাঁচার চিন্তা করতে হবে না। গায়ে জ্বলন্ত আগুন লাগার ভয় করতে হবে না। সে একদমই নিরাপদ!
রোববার রাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গাদের ১৫ জনের একটি দল বাংলাদেশে আশ্রয়রের জন্য একটি নৌকায় চেপে কিছুদূর আসতেই নাফ নদে নৌকাটি ডুবে যায়। এতে দুই শিশুসহ এক ডজনের বেশি রোহিঙ্গা মারা যায়।
তৌহিদসহ দুই শিশু ও এক নারীর মরদেহ ভাটার সময় নাফ নদের মিয়ানমার অংশের তীরে কাদায় আটকে যায়। তৌহিদকে তীরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখতে পায় সাধারণ মানুষ। হলুদ রঙের একটি শার্ট পরিহিত ছোট্ট এই শিশুর মুখ থুবড়ে পড়া ছবি এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। শুধু বিশ্ববিবেক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, শিশুটির নিথর দেহ পড়ে রয়েছে মাটিতে। কর্দমাক্ত দেহ উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। এই শিশুর সঙ্গে একই নৌকায় যাত্রী হয়েছিলেন টেকনাফে সোমবার সকালে উদ্ধার হওয়া রেহেনা বেগম। ছবিটি দেখানোর পর তিনি চিনতে পেরে বলেছেন, নিহত শিশুটির নাম তৌহিদ। তার বয়স ১০ মাস। মংডুর বড়গজিরবিল এলাকার জাফর আলম ও ছেনোয়ারার সন্তান ছিল তৌহিদ। সে সম্পর্কে রেহেনার খালাতো ভাই। ছবিতে যে স্থানটি দেখা যাচ্ছে, তা মিয়ানমারের ওপারের চিত্র।
সেনা অভিযানে নিহত রোহিঙ্গাদের অনেকেই উত্তরাঞ্চলের মংডুর রাইম্মাবিল গ্রামের বাসিন্দা। গত ৯ অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত এ অভিযানে এখন পর্যন্ত আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে বলে সংবাদমাধ্যমে চলে এসেছে। মৃত্যুর সঠিক হিসাব এখনো অস্পষ্ট। কারণ, মিয়ানমারে অভিযান চালানো এলাকায় কোনো সাংবাদিক বা মানবাধিকারকর্মীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবুও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন স্যাটেলাইট থেকে বেশ কিছু ছবি সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছে, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। পরিস্থিতি স্পষ্ট না হলেও বেশ অরাজক একটা অবস্থা, তা অনেকটা স্পষ্ট।
আয়লান কুর্দির নিথর দেহ তো এখনো আমাদের চোখ থেকে ম্লান হয়ে যায়নি। গত বছরের শেষ দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে বাঁচার আশায় মা-বাবার সঙ্গে ছোট্ট নৌকায় চেপে বসেছিল তিন বছর বয়সী শিশু আয়লান কুর্দি। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আশ্রয়ের আশায় যেতে চেয়েছিল গ্রিসের পারে। কিন্তু সাগরের উত্তাল ঢেউ চিরতরে কেড়ে নিয়েছিল আয়লান কুর্দির সেই বাঁচার স্বপ্ন। সাগরতীরে মুখ থুবড়ে আয়লান কুর্দির মতো অনেকটা তৌহিদও নিথর হয়ে পড়ে ছিল। বিশ্ববিবেকের খুব কাছে এই খবর পৌঁছাইনি। সাগরতীরে শিশু আয়লানের পড়ে থাকা মরদেহ হয়ে ওঠে বিপন্ন মানবতার প্রতীক। এ নিয়ে সে সময় বিশ্বজুড়ে তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
এবার একই চিত্র আবারও ভেসে উঠল মিয়ানমারের নাফ নদের তীরে। আমাদের খুব কাছেই ঘটল। ওরা আমাদের কাছেই আসতে চেয়েছিল। আমাদের ওরা খুব আপন ভেবেছিল। ভেবেছিল, আমাদের ভূখণ্ডে ওরা জীবন নিয়ে নিরাপদ থাকতে পারবে। ‘জাতিগত নিধনের' শিকার রোহিঙ্গাদের জ্বলন্ত প্রতীক তৌহিদের এই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা নিথর দেহ। এ যেন বিশ্ববিবেকই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকল।
বিবিসিতে প্রচারিত সংবাদে জানা যায়, জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বে সংখ্যালঘু জাতির মধ্যে সবচেয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানরা। এই তথ্য হাতে থাকার পরও বিশ্ববিবেক কি এবার জাগবে না? শান্তিতে খেতাবপ্রাপ্তরা কি এবার একটু মানবতার জন্য কিছু করবে না? নাকি এই তৌহিদের নিথর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহও তাদের মানব মন ছুঁয়ে যেতে ব্যর্থ হচ্ছে?
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।