নাফ নদে ভাসছে মানবতা
নাফ নদের অবস্থান মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে মিয়ানমার সীমান্তে। কক্সবাজার জেলার দক্ষিণ-পূর্ব দিয়ে প্রবাহিত একটি নদ এটি। নাফ মূলত কোনো নদী নয়, এটি বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত অংশ। এর পশ্চিম পাড়ে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলা ও পূর্ব পাড়ে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের আকিয়াবে অবস্থিত। বর্তমানে মিয়ানমারের অন্তর্গত আরাকান প্রদেশ ছিল একটি প্রাচীন পৃথক দেশ।
শান্ত এই নদ হঠাৎই অশান্ত হয়ে উঠেছে। ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখোমুখি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একাংশ। জীবন বাঁচানোর তাগিদে মিয়ানমারের শত শত রোহিঙ্গা নাগরিক নাফ নদে নৌকা নিয়ে ভাসছে। আরাকানদের অপরাধ, তারা সেখানে সংখ্যালঘু। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যমতে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে যা ঘটছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করে সবার ঐকমত্যে আসা উচিত।
গত কয়েক বছরে নাফ নদের ওপর যে বর্বর ঘটনা ঘটেছে, তাতে নাফ নদ যদি কথা বলতে পারত, তাহলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ১০ মাসের ছোট্ট শিশু তৌহিদের আর্তনাদের কথা বিশ্ববাসীকে জানাত। শুধু তৌহিদ নয়, অগণিত অসহায় রোহিঙ্গার জীবন বাঁচানোর করুণ আকুতির কথাও জানাত। গত বছরের শেষ দিক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া থেকে প্রাণভয়ে মা-বাবার সঙ্গে ছোট্ট নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল তিন বছর বয়সী শিশু আয়লান কুর্দি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হয় সে। আয়লানের মতো সাগরতীরে মুখ থুবড়ে পড়েছিল শিশু তৌহিদের নিথর দেহ। প্রতিদিন এমন অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটছে মিয়ানমারের আরাকানে, যার অধিকাংশ খবর আমাদের কাছে অজানাই থেকে যায়।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে অবৈধ অভিবাসী মনে করা হয় এবং দেশটিতে তাদের নেই কোনো ভোটাধিকারের সুযোগ। রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরেই নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এ অঞ্চলে। আরাকানের বৌদ্ধদের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংঘাতে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, সেনাসদস্যরা সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সময় তা দমনে কোনো ভূমিকা রাখেনি।
আন্তর্জাতিক শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর তথ্যমতে, গত দুই মাসে প্রায় ২১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ৯ অক্টোবর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৪ দিনে প্রায় ২১ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে পৌঁছেছে।’ এর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ১০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছিল জাতিসংঘ। আইওএমের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর রোহিঙ্গারা পালাতে থাকে। শরণার্থীদের বিবরণ, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সংগৃহীত স্যাটেলাইট ছবি এবং ফাঁস হওয়া ছবি ও ভিডিওতে আরাকানে কয়েক লাখ মুসলিম সংখ্যালঘুর ওপর নৃশংসতার চিত্র ফুটে উঠেছে।
এবারের সমস্যা তীব্ররূপ ধারণ করে গত ৯ অক্টোবর থেকে। নয়জন সীমান্তরক্ষী হত্যার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রকাশিত স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, ১০-১৮ নভেম্বরের মধ্যে পাঁচটি রোহিঙ্গা গ্রামে আট শতাধিক ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। তার আগে আরেকটি উচ্চ রেজ্যুলেশনের ছবিতে দেখা গেছে, ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত তিনটি গ্রামের চার শতাধিক বাড়ির ধ্বংস করা হয়েছে। বাস্তবে ধ্বংস হওয়া বাড়ি ও ভবনের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে মানবাধিকার সংগঠনটি দাবি করেছে।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে এবং আমাদের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে। নাফ নদ পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুবোঝাই আরো নয়টি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি।
২০১২ সালেও বাংলাদেশকে এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। যেহেতু বাংলাদেশ শরণার্থীবিষয়ক ১৯৫১ সালের কনভেনশনে ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি এবং জাতীয়ভাবে শরণার্থীবিষয়ক কোনো আইন নেই, তাই শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে বাধ্য নয়। তার পরও মানবিক কারণে সীমিত সম্পদ দিয়ে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।