স্বাধীন ভাবনা
গণতন্ত্রের অভাবে সংস্কৃতিচর্চা স্ববিরোধী
আর মাত্র কয়েক বছর পর স্বাধীনতা বিজয়ের অর্ধশত বছর পূর্ণ হবে। বিদ্রোহ, আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই নানাভাবে আমাদের স্বপ্ন কাজ করেছিল। শুরুতে বলে নিতে চাই, আমি প্রধানত সংস্কৃতির স্বপ্নের কথাই বলব। কিন্তু সংস্কৃতির স্বপ্ন, মৌলিকভাবে দেখা যাবে যে জীবনের সকল স্বপ্ন-সংগ্রামই হচ্ছে সংস্কৃতি। এতে কোনো ব্যক্তি বাদ পড়ে না। সংস্কৃতি মানে তো শুধু গান-বাজনা, কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, নাটক করা নয়। এটা হচ্ছে গোটা জীবনব্যবস্থা। সেদিক থেকে আমরা বলতে পারি, একটি সামষ্টিক উন্নত জীবনযাপনের প্রত্যাশা নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
২.
সামষ্টিক উন্নত জীবনযাপনের যে প্রত্যাশা বা স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তার আদর্শিক ভিত্তিটি পাওয়া যায় আমাদের ’৭২-এর সংবিধানের চার মূল স্তম্ভের মধ্যে, অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরেপেক্ষতা। আমরা এই জায়গা থেকে যদি একটু মূল্যায়ন করার চেষ্টা করি, প্রথমেই দেখলাম, স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৭৫-এ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। আরো অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়, অর্থাৎ আমাদের ওই স্বপ্নের ওপরে আঘাতের সূচনা সেখানেই। আমাদের পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। আদর্শিক ভিত্তিতে না হলেও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র চাই, অর্থাৎ চিন্তাটিকে আবার ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমাদের কিন্তু সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতেই অনেক সময় কেটে গেছে। সেই দিক থেকে যদি বলি, আকাঙ্ক্ষা-ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র। তাহলে ওইখানে তো বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করা হলো। আমরা একটি জিনিস সে সময় দেখেছি, এই ’৭৫-এ বন্দুকের মুখে ক্ষমতা দখল নিল এবং ’৯০-এর আগ পর্যন্ত আমাদের কিন্তু আবার গণতন্ত্রের জন্যই লড়াই করতে হয়েছে। সে জায়গায় ’৯০-এ আমরা এক ধরনের গণতান্ত্রিক আবহ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল জায়গাটি তো কেবল নির্বাচনের মতো নয়। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যে এর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাগে।
কিন্তু আজকে যদি ৪৫ বছর পরে এসে মূল্যায়ন করি, তাহলে দেখা যাবে, আমরা এই জায়গায় গণতন্ত্রকে একটি সুসংহত জায়গায় নিয়ে আসার জন্য যেসব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে আর যেসব সাংবিধানিক পদ রয়েছে, সেগুলোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানেরও নানা জায়গা, যেমন বলাই যায়, আমরা এত উন্নয়নের কথা বলছি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ছাত্র সংসদ নেই। তার থেকে বোঝা যায়, তৃণমূলের গণতন্ত্রের চর্চার মধ্য দিয়ে কোনো মনোনয়ন হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও যথেষ্ট গণতন্ত্র চর্চার অভাব আছে, অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আমরা করতে পারিনি।
৩.
আমরা ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কাটাছেঁড়া করায় সেটির অবস্থা এমন হয়েছে যে তাকে আর এককেন্দ্রিক কোনো আবেশের ওপর দাঁড় করানো যাবে না। এখানে অনেক কন্ট্রাডিকশন। এখন যদি বলা হয়, সেখানে রাষ্ট্রীয় ধর্ম থাকে কী করে? সেখানে ধর্মনিরপেক্ষকতাটাই বা থাকে কী করে? সহজভাবেই সেটি নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই। কাজেই সেটি আমরা ঠিক ফিরিয়ে আনতে পারিনি। আমরা ওই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নেই আসি। আজকেও তো আমরা দেখছি, ওই নাসিরনগরে কী ঘটছে। অর্থাৎ এখনো রাজনীতির স্বার্থে, ক্ষমতার আহরণে আমরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ব্যবহার করছি।
যার ফলে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনও যে করছি, সেই আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রেও; আমাদের লেখালেখি, গান, পেইন্টিং, কবিতা চর্চা, থিয়েটার—যা করছি; তাও এক ধরনের স্ববিরোধিতায় পরিণত হচ্ছে। আমরা সমাজে কিছু করেই পরিবর্তন আনতে পারিনি। কেননা, সমাজের পরিবর্তন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। রাজনীতিতে যতক্ষণ ধর্মের প্রাধান্য থাকবে, ততক্ষণ দেখা যাবে, আমি একজন লেখক হয়েও ওই রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারি। আমি মানুষের চিন্তাপৃষ্ঠে প্রভাব ফেলতে পারছি না। আমরা কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি, যার অতি উৎকট রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটা ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদ। এটা আজ প্রত্যক্ষভাবে আমাদের ওপর চেপে বসেছে।
এই জায়গা থেকে যদি বলি, জাতীয়তার জায়গাটি, দেশের মধ্যে এখনো যে বিভাজন রয়েছে, এর একটি বিরাট অংশ তো এ দেশের স্বাধীনতাকেই বিশ্বাস করে না। বিরাট অংশ পাকিস্তানি ভাবধারা নিয়ে রাজনীতি করে। এই জায়গাগুলো সামনে রেখে মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে, আজকে আমার স্বপ্ন আমি সমষ্টিগতভাবে একটি মঙ্গল চিন্তা নিয়ে আমরা বসবাস করব। সেই দিক থেকে, যে সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষা, সেই জায়গায় কিন্তু আমাদের ঘাটতি আছে। এবং কোনো কোনো জায়গায় মনে হচ্ছে, আমরা যেন আরো পেছনে ফিরে যাচ্ছি।
৪.
এটা ঠিক, আমাদের শিশুমৃত্যু হার অনেক কমে এসেছে, মাতৃমৃত্যু হার কমে এসেছে। গড় আয়ু বেড়েছে, গড় আয় বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এখন না খেয়ে থাকে না। পেটে-ভাতে তারা কিন্তু খায়। রাস্তাঘাট হয়েছে, বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের যে স্পিরিট, এটি এমন নয়, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এর মূল কথাটা হচ্ছে বৈষম্য দূর করা। কিন্তু আমরা কী করছি যে, গ্রামের একজন মানুষ কিন্তু তিনবেলা খেতে পায়। কিন্তু তার পাশেই আরেকজন তরতর করে কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বৈষম্য আমরা কমাতে পারিনি। সেখানে সব ধরনের বৈষম্য একেবারে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, জাতীয়তা বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য চেপে বসেছে। আমরা আদিবাসীদের কথা জানি, সাঁওতালদের সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটল, এগুলো আমাদেরকে বোঝায়—সমাজটা এখনো বৈষম্যের মধ্যেই রয়েছে।
৫.
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও সংকট রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা এককেন্দ্রিক নয়। সেখানেও কিন্তু বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। সেদিন আমি দৈনিক সংবাদে একটি খবর দেখলাম। সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিএসসি পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন করা হয়েছে এ রকম, সৌরভের (সম্ভবত) ধর্ম কী? বিকল্প চারটি উত্তর—মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রদের এ ধরনের প্রশ্ন করে তাদের মনে সূক্ষ্মভাবে সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ মানুষ মাত্রই তার পরিচয়টা হচ্ছে ধর্মীয়!
আমরা যাঁরা সংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিত, যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করি; তাঁরা শিক্ষক, কবি, সাংস্কৃতিক, নাট্যকার, শিল্পী, চিত্রশিল্পী, গায়ক হতে পারি। সেই জায়গাটাতেও আমরা দেখছি, সমাজের এইসব পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও অতীতে যেভাবে ভূমিকা পালন করেছি, সেই ভূমিকার জায়গাটিতে কেন যেন একটা ভোগ-লোভ যুক্ত হয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও বিরাট অংশ চলে গেছে একটা মোসাহেবি সংস্কৃতির দিকে। পাবোকের সংস্কৃতির দিকে চলে গেছে। সেটা কিন্তু খুবই দুঃখজনক।
৬.
আবার সব পরিবর্তনের সঙ্গে কিন্তু আমরা দেখেছি যুবসমাজ যুক্ত থেকেছে। সেটি বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত। আমাদের রাজনীতির পরিশীলতার অভাবের কারণে এই যুবসমাজের মধ্যে এখন সেই জাগরণটা দেখছি না। পাশে একটি অন্যায় ঘটলে যুবকরা যেভাবে এগিয়ে আসার কথা, সেখানে আমরা কিন্তু তাদের সাড়া কম পাই। মানববন্ধনের মতো কয়েকটি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই শেষ। যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, ভবিষ্যতে আমরা যদি সেদিকে এগোতে চাই, সেই জায়গায় আমাদের অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে এখনো। এ পর্যন্ত দেশের যত উন্নয়ন হয়েছে, সব কর্মকাণ্ড তো মানুষের মুক্তির জন্য; মানুষের চিন্তার মুক্তির জন্য, অর্থাৎ একটি শোভন সংস্কৃতিমান সমাজ নির্মাণের জন্য। সেই শোভন সংস্কৃতিমান সমাজ নির্মাণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার জন্য যদি ১০টি সিঁড়ি থাকে, সেখানে একটি বা দুটি সিঁড়িতে হয়তো আমরা পা রাখতে পেরেছি। তার বেশি কিছু নয়।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব, অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।