মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট : বিপন্ন মানবতা
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/12/16/photo-1481886433.jpg)
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সামরিক বাহিনীর চলমান অভিযানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছে বিশ্ব। এ ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ায় মিয়ানমার দূতাবাসের সামনে জনসাধারণের বিক্ষোভ এবং মালয়েশিয়ায় গণবিক্ষোভের কথা বলা যায় যেখানে স্বয়ং দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের উপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, ইসলামিক ফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের বিক্ষোভ প্রদর্শন ছাড়াও বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি ব্যতীত বাকি কর্মসূচিগুলোর ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হচ্ছে, মিয়ানমারে চলমান ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তালিকায় রয়েছে প্রথমত : ইন্দোনেশিয়া এবং দ্বিতীয়ত : মালয়েশিয়া; বলাই বাহুল্য, দুটিই মুসলিমপ্রধান দেশ এবং তৃতীয়ত : বাংলাদেশে। এ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের প্রতিবাদ কর্মসূচি ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখ করার মতো কোনো প্রতিবাদ নজরে পড়েনি।
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা বাংলাদেশের ইসলামী দলের প্রতিবাদে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং এমন অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত দেশটির নিকটতম প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করার মতো ক্ষমতাধর দেশ ভারত কেন নিশ্চুপ? প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ এগুলো না হয় ততটা প্রভাবশালী নয়, কিন্তু আরেক পরাশক্তি চীনের তরফ থেকে কোনো সাড়া নেই কেন? বাংলাদেশের সুশীলসমাজেরই বা হলোটা কী?
মিয়ানমারে নির্বিচারে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ মারা পড়ছে প্রতিদিন, এ সত্যকে ছাপিয়ে এখন তারা ‘মুসলমান’- এ পরিচয়ই কি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে? যে দোষে তাদের ওপর এমন নির্বিচার জুলুম, সেই একই কারণে কি অত্যাচারের প্রতিবাদেও এই একপেশে নীতি? মানবতা নয়, মানবিকতা নয়, বরং কারো প্রতি কারো সহানুভূতিটাও আসে এখন ধর্মীয় বিবেচনায়; মুসলিমদের জন্য আজ শুধু মুসলিমদেরই সহানুভূতি বরাদ্দ। বাংলাদেশের হিন্দুরা আক্রান্ত হলে উদ্বেগ শুধু ভারতের। বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা অন্যায়ের শিকার হলে প্রতিবাদ শুধু সেই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের। ধর্মের রাজনীতিকরণ আর দেশে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের স্বার্থান্বেষী মনোভাবের শিকার হচ্ছে এসব নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ।
মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী পুলিশ ফাঁড়িতে মুসলিম জঙ্গিদের হামলার বিষয়টি এড়িয়ে গণমাধ্যমে একপেশে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। সু চির এ বক্তব্য কি সাম্প্রদায়িকতাকে আরো বৈধতা দিচ্ছে না? হ্যাঁ, রোহিঙ্গা মুসলিমদের একাংশের নেতৃত্বাধীন জঙ্গি সংগঠনের (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন বা আরএসও) তৎপরতা কারো অজানা নয়। একই সঙ্গে এটাও কারো অজানা নয় যে, একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নিজেদের প্রাপ্য অধিকার থেকে কতটা নির্মমভাবে এবং কতটা দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত হওয়ার পর তাদের একটি অংশ অধিকার আদায়ের তাড়নায় সহিংস হয়ে ওঠে। অস্বীকার করার উপায় নেই, অধিকার আদায়ে তাদের এ পন্থা সঠিক নয়; কিন্তু যে নির্মম বাস্তবতা থেকে এর সূত্রপাত সেটিই কি অস্বীকার করার উপায় রয়েছে কোনো রাষ্ট্রের? আর এটি শুধু রোহিঙ্গা বলে নয়, বরং যে কোনো দেশের যে কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
তাই পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ফলস্বরূপ জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে সমস্যার মূলে গিয়ে এর স্থায়ী এবং অবশ্যই অহিংস সমাধানের পরিবর্তে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার এ পদ্ধতির পক্ষে কোনো যুক্তি কি রয়েছে সু চির? নাকি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে কমিশন গঠনের মধ্য দিয়েই তিনি ভেবে নিয়েছেন তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে? শুধু এতেই থেমে নেই মিয়ানমার; বরং রোহিঙ্গারা দেশটির আদি বাসিন্দা নয় এ-সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ নিয়ে নতুন করে ইতিহাস লিখতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কথাও সম্প্রতি জানিয়েছে দেশটি।
গণতন্ত্রের প্রতীক বলা হতো সু চিকে; একসময় সু চি আর গণতন্ত্র ছিল সমার্থক। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর আত্মত্যাগের কথা রূপকথাকেও হার মানায়। এখন হয়তো সে রূপকথা নতুন করে লেখার সময় এসেছে। কারণ, যেখানে অং সান সু চির মতো নেতা ক্ষমতায় থাকার পরও তার দেশে ‘মানবতার’ এমন চরম বিপর্যয় বিশ্ববাসীকে দেখতে হচ্ছে, সেখানে যদি শুধু ‘মুসলিম’ পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশেষ দেশ বা মহলের সহানুভূতি ছাড়া আর কারো মুখে কোনো আওয়াজ না শোনা যায় তাহলে হয়তো এতে আর বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা বর্তমান স্বার্থান্বেষী ধর্মীয় রাজনীতির এ যুগে ‘মানবিকতা’ শব্দটির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। যদিও সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের মিয়ানমার সংশ্লিষ্ট এ তৎপরতা বিভেদ উসকে দিচ্ছে বলে সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তার এ বক্তব্যও যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা বিজয় নাম্বিয়ার সম্প্রতি সু চিকে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের আহ্বান জানানোসহ দেশটির বিপন্ন এ গোষ্ঠীর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ত্রাণ পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো বন্ধের হুমকি দেওয়াসহ মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানের সম্মেলন আহ্বান করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মিয়ানমারের এ ধরনের তৎপরতা সমস্যা সমাধানের বদলে তা আরো জটিলই করে তুলবে; আর এ অবস্থায় সংকট উত্তরণে এর বিপরীতে প্রয়োজন জোরালো ও নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সাংবাদিক।