দুর্ভাগা তোফাজ্জলের জীবনের সমাপ্তিটাও হলো নিঠুর নির্মমতায়
মা মারা গেলেন ক্যান্সারে। একমাত্র বড় ভাইও মারা গেলেন ক্যান্সারে। বাবা মরলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। হৃদয় পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে চলে গেছে ভালবাসার প্রিয়তমা। সব হারিয়ে অবশেষে মানসিক ভারসাম্যহীন। পরিবার পরিজন বলে কিছুই নেই তোফাজ্জেলের। এ কেমন নিয়নি দুর্ভাগা জীবনের সমাপ্তিটাও হলো তাঁর নিঠুর নির্মমতায়।
বাংলা সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছিলেন পিরোজপুর সরোয়ার্দী কলেজ থেকে। পাথরঘাটা সরকারি কলেজ থেকে ২০১১ সালে তার এইচএসসি। ২০০৯ সালে পাথরঘাটার কাঠালতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তার এসএসসি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারানো তোফাজ্জল হোসেনের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায়। প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা আর একের পর এক স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে চার বছর আগে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তোফাজ্জেল। বাবা, মা, ভাই, বোন কিছুই না থাকার কারণে মৃত্যুর আগে সামান্যতম চিকিৎসাটাও হলো না তার।
স্থানীয়রা জানান, মেধাবী তোফাজ্জল হোসেন অতীতে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত ভালো, পরিচ্ছন্ন ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তোফাজ্জল। বাবা মা আর একমাত্র বড় ভাইকে নিয়ে সাজানো গোছানো সংসার ছিল তাদের। বাবা আব্দুর রহমান ছিলেন ব্যবসায়ী। চরদুয়ানি বাজারে জুতার দোকান ছিল তাঁর। বড় ভাই নাসির উদ্দিন ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের একজন সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই)। পিরোজপুর জেলায় কর্মরত থাকায় বড় ভাইয়ের কাছে থেকেই লেখাপড়া করেন তোফাজ্জেল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের তিলক যার কপালে। তার যে ভাল থাকার উপায় নেই। আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার বাবা। এরপর বছর চারেক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় মা বিউটি বেগমের। একদিকে প্রিয়তমাকে না পাওয়ার বেদনা, আরেক দিকে মা হারানোর শোক। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় তোফাজ্জলের।
তোফাজ্জলকে সুস্থ করতে নিজের কাছে নিয়ে যান বড় ভাই পুলিশ কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন। হঠাৎ করেই লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে বড়ভাই নাসির উদ্দিনের। কিছুদিন পরেই মৃত্যু হয় তাঁর। বাবা, মা, ভাই, বোন সব হারিয়ে একসময় শুরু হয় তোফাজ্জেলের ভবঘুরে জীবন।
তোফাজ্জলকে মাঝে মাঝে পাথরঘাটা দেখা গেলেও অধিকাংশ সময় তিনি থাকতেন লাপাত্তা। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তাকে দেখেছেন পাথরঘাটার অনেকে। কখনো উদোম শরীরে, আবার কখনো নোংরা পোশাকে তাকে দেখা যেত ঢাবিতে। পরিচিত কেউ তাকে দেখলে খাবার কিনে দিতেন। আবার কারো কারো কাছ থেকে হাত পেতেও টাকা নিতেন দুমুঠো খাবারের জন্য।
মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করায় ক্ষুব্ধ পাথরঘাটার স্থানীয় বাসিন্দারা। আজ শুক্রবার সকাল ৯টায় পাথরঘাটার কাঠালতলী গ্রামে জানাযা শেষে দাফন করা হবে তাকে। দাফন শেষে চরদুয়ানী বাজারে নির্মম এ হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করেছে তোফাজ্জলের বন্ধু-স্বজন ও গ্রামবাসী।
ঢাবির আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও পাথরঘাটার বাসিন্দা আল ইমরান বলেন, ‘তোফাজ্জল গতকালই যে প্রথম ঢাবিতে গিয়েছে এমনটা নয়, আমি আমার শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন সময়ে তোফাজ্জলকে বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি। তাকে আমি খাবার কিনে দিয়েছি। খাবার খাইয়েছি। কখনো তিনি আমার কাছে খাবারের জন্য ছুটে এসেছেন। খাবার দিতে না পারলে আমি তাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। তোফাজ্জল চোর ছিলেন না। তিনি হলে গিয়েছিলেন খাবারের জন্য। একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে চোর অপবাদ দিয়ে এভাবে নির্মম নির্যাতন করা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তোফাজ্জলকে আটকের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দেখতে পাই। তখন ঢাবিতে আমার পরিচিত কয়েকজনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তোফাজ্জল যে মানসিক ভারসাম্যহীন তা আমি তাদেরকে জানাই। তারপরও একটি মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা কখনো ক্ষমাযোগ্য অপরাধ হতে পারে না। আমি তোফাজ্জলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
পাথরঘাটার চারণ কবি ইদ্রিস আলী বলেন, ‘সকালে ফজরের নামাজ পড়ে তোফাজ্জলের মৃত্যুর খবর শুনে হতভম্ব হয়ে যাই। মেধাবীরা কি করে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। ছেলেটির মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই। অভিভাবকহীন এ রকম একটি মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
নিহত তোফাজ্জলের কোনো অভিভাবক না থাকায় অপরাধীরা যাতে পার না পেয়ে যায় সেজন্য রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানান তিনি।
পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হোসাইন বলেন, ‘তোফাজ্জল অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী একটি ছেলে ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। আমিসহ পাথরঘাটার অনেকেই তোফাজ্জলকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি, খাবার কিনে দিয়েছি, চিকিৎসারও উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে মানুষকে চাইলেই তো আর সুস্থ করে তোলা যায় না। আমরা তোফাজ্জলকে সুস্থ করে তুলতে পারি নি। তাই বলে তোফাজ্জলকে যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা আমরা মেনে নিতে পারি না। আমরা তোফাজ্জলের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
লেখক : সোহেল হাফিজ, বরগুনা প্রতিনিধি।