পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা বাড়াতে বিএসইসির আইনের সংশোধন চায় সম্মিলিত পরিষদ

পুঁজিবাজার সব স্টেকহোল্ডারদের সুচিন্তিত মতামতে পারস্পরিক অনাস্থা দূর করে বিনিয়োগকারীদেরকে আস্থায় নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় ধারাবাহিক পুঁজিবাজারের পতন ও অযোগ্যতার দায়ভার বিএসইসির চেয়ারম্যানকে মেনে নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের নেতারা। তারা বলেন, পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা বাড়াতে বিএসইসির আইনের সময়োপযোগী সংশোধন করতে হবে।
গতকাল শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) হলরুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরেন সংগঠনটির সভাপতি আতাউল্লাহ নাঈম।
জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোতে বিনিয়োগকারীরা হারাচ্ছে মূলধন জানিয়ে আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, ২৮টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানো হয়েছে। এতে শেয়ারধারীরা মূলধন হারাচ্ছে। তাদের ক্ষতি থেকে রেহাই দিতে শিগগিরই এবিষয়ে যৌক্তিক সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, গত পনের বছর পুঁজিবাজারের কারসাজিতে সৃষ্ট পতনে সর্বস্ব হারিয়ে যেসব বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা ও হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন, সেইসব বিনিয়োগকারীদের পরিবার থেকে একজনকে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একই সাথে পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীদের পুঁজির যোগান করে দিতে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনের এসময় সভাপতি লিখিত ১২ দাবি তুলে ধরেন। এসব দাবিগুলোতে উল্লেখ করা হয়- সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৮টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোর কারণে শেয়ারধারীরা মূলধন হারাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট-কোম্পানিগুলোকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। কোম্পানি সম্পর্কিত নন-কমপ্ল্যায়েন্সের জন্য পরিচালকদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট জব্দ করে কমপ্ল্যায়েন্স ঠিক করতে হবে। তাহলে লভ্যাংশ বিতরণের অনিয়ম দূর হবে। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সব স্টেকহোল্ডারদের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করে পারস্পরিক অনাস্থা দূর করে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ধারাবাহিক মার্কেট পতন ও অযোগ্যতার দায়ভার নিয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যানকে তার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজির নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় আমাদের দেশে ‘পুঁজি বিনিয়োগ আইন’ প্রণয়ন কার্যকর করতে হবে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত লভ্যাংশ না পেলে কিংবা কোম্পানিগুলো প্রতারণার আশ্রয় নিলে যেন আইনি সুযোগ নেওয়া যায় তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। বিএসইসিকে পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা বাড়াতে আইনের সময়োপযোগী সংশোধন করতে হবে।
বিগত পনের বছর কারসাজির কারণে সৃষ্ট পতনে সর্বস্ব হারিয়ে যেসব বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা ও হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন তাদের পরিবার থেকে এক জনকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া ২০১০ সালের ধসের পর থেকে আজ অবদি পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীদের ৫০ শতাংশ পুঁজির যোগান দিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চিহ্নিত কারসাজিকারীদের কারণে মহাধসের পর থেকে যেসকল পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজির রক্ষায় আন্দোলন করতে গিয়ে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার স্বীকার হয়েছেন তাদের মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহার করতে হবে। মিথ্যা মামলা চালাতে গিয়ে যত টাকা খরচ হয়েছে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিনিয়োগকারীদের সঠিক তথ্য না দেওয়া, প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করা, কোম্পানির বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া এবং দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে এজিএম সম্পন্ন করে কোম্পানির এজেন্ডা পাশ করানোর মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোতে গিয়ে বিভিন্ন সংস্থার নামে চাঁদা আদায় ও এজিএমকে ঘিরে চলমান অনিয়ম দুর্নীতি অনুসন্ধান করে প্রকৃত দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অবিলম্বে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
পুঁজিবাজারের বর্তমান সংকটকালে ব্যাংকগুলোকে সংকট উত্তরণে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ রাইট শেয়ার ছেড়ে সুবিধামতো সময়ে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। তাই পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ নিশ্চিত করার কার্যকর ভূমিকা ও উদ্যোগগ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে পলিসি সাপোর্ট দিতে হবে।
সবকিছু শুধু আইন দিয়েই হয় না, মানবিক বিষয়টি অনেক সময় আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যায়। কারণ আইন যেহেতু মানুষের জন্যই। বর্তমান ধারাবাহিক দরপতনে বিনিযোগকারীরা নিঃস্ব। সুতরাং মানবিক কারণে ফোর্সসেল আপাতত বন্ধ রাখতে হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজারকে অব্যাহতভাবে গতিশীল রাখার স্বার্থে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বড় বিনিয়োগকারীদের বাজারে সক্রিয় করতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেই ইক্যুইটি মাইনাস একাউন্টগুলো দ্রুত লেনদেনের আওতায় আসবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোয় মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার হাউজগুলোকে তহবিল বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অর্থ সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে বিএসইসির উদ্যোগ নিতে হবে।
এছাড়া অতিদ্রুত বাইব্যাক আইন করতে হবে। কারণ সেকেন্ডারি মার্কেটে মৌলভিত্তি সম্পন্ন অনেক শেয়ারের মূল্য ফেসভ্যালুর কাছাকাছি। এমতাবস্থায় প্রিমিয়ামসহ ইস্যু মূল্যের নিচে শেয়ার দর নামলে তা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি অথবা মালিককে বাইব্যাক করতে হবে।
আইনি নির্দেশনা থাকার পরও ইস্যু ম্যানেজাররা মৌলভিত্তি সম্পন্ন ইস্যু না এনে, নাম সর্বস্ব কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে অধিক প্রিমিয়ামসহ আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করার পর আর কোনো দায়বদ্ধতা নিতে চায় না। অথচ তালিকাভুক্তির তিন বা ছয় মাসের মাথায় অনেক কোম্পানি বিভিন্ন অজুহাতে বিনিয়োগকারীদের অর্থ বছরের পর বছর আটকে যায়। এর জন্য দায়ি ইস্যু ম্যানেজারদের চিহ্নিত করে জরিমানা আদায় পূর্বক লাইসেন্স বাতিল ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নতুন কোম্পানির সেকেন্ডারি মার্কেটে তালিকাভুক্তির পর তাদের সার্বিক কার্যক্রম সঠিক মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এর বাইরে সংবাদ সম্মেলনে ‘পুঁজিবাজার বিষয়ক তথ্য ব্যাংক’ গঠন করে বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সকল প্রকার তথ্য নির্দিষ্ট স্থান থেকে সংগ্রহ করার সহজ সুবিধা নিশ্চিত করতে বিএসইসিকে ডিএসই ও সিএসই সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।