দক্ষদের ছাড়াই চলছে বিএসইসির কার্যক্রম!
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একজন কর্মকর্তা দৈনিক ২১টি গুরুত্বর্পূণ ফাইল একাই দেখছেন বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট এক্সপার্টদের ছাড়াই চলছে বিএসইসির কার্যক্রম।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মাল্টিপারপাস হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আল-আমিন এসব কথা বলেন। এতে উপস্থিত ছিলেন টাস্কফোর্সের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর জ্যেষ্ঠ অংশীদার এএফএম নেসারউদ্দীন এবং পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপের সদস্য প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি মো. মনিরুজ্জামান।
এ সময় মার্জিন রুলস-১৯৯৯ যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে চূড়ান্ত সুপারিশ তুলে ধরেন পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্যরা। সেখানে একজন বিনিয়োগকারী ১:১ অনুপাতে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত মার্জিন ঋণ নিতে পারবেন বলে সুপারিশ করেছে এই টাস্কফোর্স। তবে সব বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিতে পারবেন না। পুঁজিবাজারের বাইরে যেসব বিনিয়োগকারীর মাসিক আয়ের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা আছে তারাই মার্জিন ঋণ নিতে পারবেন। লকইন শেয়ার, উদ্যোক্তা শেয়ার, প্লেসমেন্ট, অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান, বন্ড, ডিবেঞ্চার ও অতালিকাভুক্ত মিউচুয়াল ফান্ডে মার্জিন ঋণের অর্থ ব্যবহার করা যাবে না। কোম্পানির বেলায় মার্জিন ঋণ গ্রহীতা নিজস্ব শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবে না। বিনিয়োগকারির দুটি বেনিফিশিয়ারি হিসাব থাকতে পারবে। এর মধ্যে একটি মার্জিন ও অন্যটি নন-মার্জিন হিসাব। মার্জিন হিসাব ঋণাত্বক হলে নন-মার্জিন হিসাব থেকে শেয়ার বিক্রি করে অর্থ আদায় করতে পারবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান।
সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে- নতুন তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান (আইপিও) এর শেয়ার ক্রয়ে ৯০ দিনের পূর্বে মার্জিন ঋণ দেওয়া যাবে না; ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদে মার্জিন ঋণ দেওয়া। মেয়াদ শেষে তা নবায়নের সুযোগ থাকবে; ঋণ দেওয়ার আগে গ্রহীতা বিনিয়োগকারীর সক্ষমতা যাচাই বা ক্রেডিট রেটিং তৈরি করবে ঋণদাতা কোম্পানি; ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে শুধু পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ শ্রেণির কোম্পানি ও বিবিবি+ রেটিংয়ের মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ জামানত হিসেবে রাখতে পারবে। এর বাইরের কোনো বিনিয়োগ জামানত হিসেবে রাখতে পারবে না ঋণদাতা কোম্পানি। নগদ টাকা জামানত হিসেবে রাখা যাবে; স্টক এক্সচেঞ্জ ঘোষিত নির্দিষ্ট কোম্পানির বিপরীতে মার্জিন ঋণ দেওয়ার সুযোগ রাখা যাবে। লেনদেন স্থগিত ও দেউলিয়া বা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা শোচনীয় থাকলে মার্জিন ঋণে শেয়ার কেনা যাবে না; এর মধ্যে ‘এ’ শ্রেণির কোম্পানি, যাদের মূল্য–আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ৩০ এর বেশি না হলে মার্জিন ঋণ নিতে পারবে; একক কোনো গ্রাহকের বিপরীতে ঋণদাতা কোম্পানি তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ মার্জিন ঋণ দিতে পারবে; ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মার্জিন ঋণ দেওয়ার সময়ে শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্যকে বিবেচনায় নিতে হবে। শেয়ার প্রতি আয়কে বিবেচনায় নেওয়া যাবে না।
বিএসইসিতে জনবল ও দক্ষকর্মীর অভাব রয়েছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, পুঁজিবাজার খুবই স্পর্শকাতর জায়গা। সেই হিসেবে বিএসইসিতে সেই রিলেটেড নেই এক্সপার্টকর্মী। নেই দক্ষ অ্যাকাউন্টস ও বিশেষজ্ঞ। এমনকি এসব এক্সপার্টদের যেই পরিমাণ সম্মানি দিয়ে রাখা হয়, বিএসইসিতে সেই ধরনের সম্মানি দেওয়ার কোনো সুযোগও নেই। এমনভাবেই চলছে বিএসইসি কাজ। আমরা দেখেছি, বিএসইসির এক কর্মকর্তা দৈনিক ২১টি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল একাই দেখছে। বছরের পর বছর কীভাবে বিএসইসির এই গুরুত্বর্পূণ কাজ করছে, সেটাই প্রশ্ন।
আমরা এমন বিনিয়োগকারিদের মার্জিন ঋণ দিতে বলেছি, যাদের নিয়মিত আয়ের উৎস আছে মন্তব্য আল-আমিন বলেন, ঋণের তো সুদ দিতে হবে, কমপক্ষে সেই সুদ পরিশোধ করতে পারে তার নিশ্চয়তা তিনি যেন দিতে পারেন।
মার্জিন ঋণের দায় বিনিয়োগকারিকে বহন করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান ঋণ দিয়েছে, তারা তদারকি করবে। লোকসান হলে শেয়ার বিক্রি করে সমন্বয় করে নেবে। নেগেটিভ ইক্যুইটি হওয়ার সুযোগই থাকবে না। অটোমেটিক সেল করতে হবে। এটি না করায় এখন বাজারে নেগেটিভ ইক্যুইটি অনেক। তাতে বাজারের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারিরা চলে যাচ্ছেন। নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে, বিনিয়োগ হিসাব ঋণাত্বক হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে টাস্কফোর্সের কোন সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে আল-আমিন বলেন, আমরা ভবিষ্যত পুঁজিবাজারের জন্য কাজ করছি। টাস্কফোর্সের কাজ বাজারে বিনিয়োগকারী এনে দেওয়া না। আমরা বিনিয়োগকারীদের পুঁজি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছি। আমরা গত কয়েক বছরের মতো অবস্থার যেন ভবিষ্যতে পুঁজিবাজারে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। পুঁজিবাজার প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা দূর করতে কাজ করছি।
আমরা সময় নিয়ে কাজ করছি জানিয়ে আল-আমিন বলেন, পুঁজিবাজারের ক্ষত জায়গা ও সমস্যাগুলো বের করছি। সুষ্ঠুভাবে কাজের স্বার্থে আমরা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ও অংশীজনদের সাথে বসছি, আলোচনা করছি। পুঁজিবাজারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের মতামত ও পরামর্শ নিচ্ছি। প্রতিটা জায়গায় আমরা ফোকাস গ্রুপ আর কনসালটেশন গ্রুপ করেছি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং পুঁজিবাজারে আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স গঠন করে বিএসইসি। পরবর্তীসময়ে টাস্কফোর্সের পরামর্শ এবং তাদের কাজের সহযোগিতার জন্য পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপ গঠন করা হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স কমিশনের কাছে মার্জিন রুলস, ১৯৯৯ এর যুগোপযোগী করার বিষয়ে খসড়া সুপারিশ জমা দেয়। পরবর্তীতে ওই খসড়া সুপারিশের ওপর সংশ্লিষ্ট সবার মতামত আহ্বান করা হয়। জমা পড়া মতামত বিবেচনায় নিয়েই পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স এই সংক্রান্ত চূড়ান্ত সুপারিশ প্রস্তুত করে। যা গতকাল রোববার বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কাছে মার্জিন রুলস-১৯৯৯ যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দেন পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্যরা।