নীল আকাশ, সবুজ ঘাস ও একজন ডি মারিয়া
‘জীবন একটি একক মুহূর্ত নিয়ে তৈরি, যে মুহূর্তে একজন মানুষ সবার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান’–কথাটি আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসের বলা। এক জীবনে সবসময় সবার জন্য কিছু করা হয়ে ওঠে না। সাধ থাকলেও সেই সামর্থ্য হয় কজনের?
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। সমান্তরালে তাকে পেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পারেন আর্জেন্টিনার মানুষ। যার পায়ে ঘটেছে ২৮ বছরের শিরোপা না পাওয়া উন্মাদ কান্নার অবসান, যার পায়েই শুরু বিশ্বজয়ের নতুন এক অধ্যায়ের, তাকে পাওয়াটা ভাগ্য নয় তো কী! বোর্হেসের কথার মতোই ডি মারিয়াও তো নিজেকে খুঁজে পান সবার মাঝে। ফুটবলার হওয়ার আগে তিনিও তো ফ্যানবয়ই। তিনিও তো কেঁদেছেন বহু ফাইনালে। শেষ পর্যন্ত হাসিটাও এনে দিয়েছেন, মিশেছেন জনতার ভিড়ে।
জন্মেছেন ভালোবাসা দিবসে। ফুলের বদলে ভালোবাসেন ফুটবলকে। ফুটবল তাকে গ্রহণ করেছে, দুহাত ভরে দিয়েছে—যেমন দেয় আঁজলা ভরা জল, যেমন করে মুখে তুলে দেয় দই-চিনি। ভক্তরাও তাকে ভালোবেসেছেন। এমন দিনে জন্মেছেন বলেই বোধহয় উদযাপনে দুহাত দিয়ে ‘হার্ট শেপ’ দেখান ভক্তদের। তাদেরও তো কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে না কি?
বুঝতেই পারছেন কার কথা বলা হচ্ছে? অ্যাঞ্জেল ফাবিয়ান ডি মারিয়া হার্নান্দেজ। আর্জেন্টাইন ফুটবলে মেসি যদি সাগর হন, ডি মারিয়া ঢেউ। যে ঢেউয়ের তালে তালে গোটা সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। যাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। অনুভব করতে হয় চোখ বুঝে। আর সৌন্দর্য অবলোকনে তাকিয়ে থাকতে হয় তন্ময় হয়ে।
ডি মারিয়ার ডাকনামটা বেশ মজার। ‘এল ফ্ল্যাকো’। বাংলা করলে যা অর্থ দাঁড়ায় ‘হাড্ডিসার’। দেখতে একেবারে কাঠির মতো মারিয়ার নামটা বোধহয় ঠিক আছে। সতীর্থরা অবশ্য আদর করে ডাকে ‘ফিদেও’ বলে। যার অর্থ নুডলস। নুডলসের মতো এঁকেবেঁকে সারা মাঠ চষে বেড়ান বলেই বোধহয় এমন নাম। আরেকটা নাম আছে। সেটি আনঅফিসিশিয়াল। কিন্তু, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ– ‘ফাইনালম্যান’! আলবিসেলেস্তেদের সর্বজয়ী হয়ে ওঠার পেছনে তার পায়ের ভূমিকা অন্তত ফাইনালে অন্যদের চেয়ে বেশি। গত তিন বছরে তিনটি শিরোপা জেতা দলটির প্রত্যেক ফাইনালে গোল দেওয়া একমাত্র নাম ডি মারিয়া। চতুর্থ ফাইনালে গোল পাননি, তবু তিনি ছিলেন আপন ছন্দে।
ফাইনালম্যান হোক কিংবা ফ্ল্যাকো অথবা নুডলস–ডি মারিয়া সব নামেই যেন মিশে যান। যেমনটা মিশে গেছেন আর্জেন্টিনার আকাশী-নীলের সঙ্গে। তিনি বরাবরই যেন পর্দার আড়ালের হিরো। এত ভালো খেলেছেন, অর্জনে কোনো অংশে কম নন লিওনেল মেসির চেয়ে। তবু, তিনি সর্বকালের সেরা নন! সর্বকালের সেরার হিসাব তো বাদই, তার নিজ পজিশনেও তিনি সেরাদের সেরা নন। ডি মারিয়া অবশ্য এমন একজন, যিনি খেলেন দলের জন্য। যারা দলের জন্য খেলে, তাদের কি অতশত হিসাব করলে চলবে? মেসির সমান আন্তর্জাতিক ট্রফি নিয়েও (জাতীয় দল ও ক্লাব মিলিয়ে) তাই তিনি পার্শ্বনায়ক। সেই পার্শ্বনায়ক, যাকে ছাড়া মেসি কখনোই মহানায়ক হতে পারতেন না।
ডি মারিয়াকে তুলনা করা যেতে পারে এঁটেল মাটির সঙ্গে। আঠার মতো লেগে থাকেন সবুজ ঘাসে। ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না। ভাগ্য না কি সব সময় সাহসীদের পাশে থাকে। লোকে আবার বলে, সাহসীরাই ভাগ্যবান হন। শিরোপার কত কাছে গিয়ে আলোকবর্ষ দূর হতে প্রতিপক্ষকে উল্লাস করতে তো কম দেখেননি। বিশ্বকাপ, কোপা সবখানেই ফাইনালে হারার কান্নাকে রূপান্তর করেছেন আনন্দ অশ্রুতে। ওই যে, পরাজয়ে দরজায় খিল দিয়ে কাঁদতে পারেন সবাই। তবে, দরজা ভেঙে দরাজ কণ্ঠে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে পারাটাই আসল সাহসিকতা। এই আর্জেন্টিনা সেই সাহসীদের আঁতুরঘর। সেই ঘর দাঁড় করাতে লিওনেল স্কালোনি নামক কন্ট্রাক্টরের বড় কারিগর তো ডি মারিয়াই।
লিওনেল স্কালোনি টু লিওনেল মেসি, দুই লিওনেলের মাঝে ডি মারিয়াকে অনায়াসেই সংযোগ সেতু বলা যায়। সেই ডি মারিয়া থেমেছেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন চোখের জলে। কী অদ্ভুত, বিন্দু বিন্দু সেই জল বিদায়ের আগে গড়েছে সিন্ধু। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জলের সমন্বয়ে গড়ে তোলা মহাদেশ, অতল সাগরের মতো ডি মারিয়া সেভাবেই দলকে গড়ে তুলেছেন কান্না আর শ্রমের মিশেলে।
২০০৮ সালে অভিষেকের পর আর্জেন্টিনার আকাশী-নীল গায়ে চাপিয়েছেন ১৪৫ ম্যাচ। করেছেন ৩১ গোল। অ্যাসিস্ট ৩২টি। পরিসংখ্যানের যদিও সাধ্য নেই তাকে ব্যাখ্যা করার। ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি যা করেছেন ফুটবল মাঠে, তা স্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছু। ভিনসেন্ট ভ্যান গগ বলেছিলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি চিত্রকল্প তৈরির এবং আমি রংতুলিতে স্বপ্ন এঁকেছি।’ ৩৬ বছর বয়সী ডি মারিয়া ঠিক সেটিই করেছেন। বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্নকে রূপান্তর করেছেন বিশ্বজয়ের তকমা গায়ে লাগিয়ে।