ফিরে দেখা ২০২৪
ক্রিকেটে ব্যর্থতা, আক্ষেপ, বিতর্ক ও উত্থান
মহাকালের অতল গর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় আরও একটি বছর। ভালো-মন্দ মিলিয়ে নানা ঘটনায় আলোচিত ছিল ২০২৪ সাল। দেশের মাটিতে যাই ঘটুক না কেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য বছরটা মন্দ যায়নি। এসেছে বেশ কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্য। বছর শেষে সাফল্য-ব্যর্থতার পাল্লার দিকে চোখ বোলানো যাক…
পরাজয়ে বছর শুরু
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বিপিএল থাকায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মাঠে নামে মার্চে। দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার কাছে অনুষ্ঠিত সেই সিরিজে টি-টোয়েন্টিতে হারলেও চট্টগ্রামে ঘুরে দাঁড়ায় ওয়ানডেতে। টেস্ট সিরিজেও হারে বাজেভাবে। এরপর বিশ্বকাপের ঠিক আগে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলে বাংলাদেশ। সেই সিরিজে তুলে নেয় ৪-১ ব্যবধানে জয়।
নবাগত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিরিজ হার
বছরের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা বাংলাদেশ খায় মে মাসে। ক্রিকেটে অনেকটা নবাগত যুক্তরাষ্টের কাছে বিশ্বকাপের ঠিক আগে সিরিজ হারে বাংলাদেশ। দুঃস্বপ্নের সেই সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হারে নাজমুল শান্তর দল। যা বেশ বিপাকে ফেলে পুরো দলকে। প্রথম দুই ম্যাচ হারলেও তৃতীয় ম্যাচে বড় জয়ে হোয়াইটওয়াশ এড়ায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। ওয়ার্ম আপ ম্যাচে ফের একবার যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছিল বাংলাদেশ,তবে বৃষ্টিতে সেই ম্যাচ বাতিল হয়।
১৭ বছর পর বিশ্বকাপের সুপার এইটে বাংলাদেশ
২০০৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় উদ্বোধনী আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুল-আফতাব আহমেদের সুবাদে সেবার বাংলাদেশ গিয়েছে সুপার এইটে। এরপর বিশ্বকাপের মূলপর্বে একটি জয়ের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০২২ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। সেবার নেদারল্যান্ডসকে ৯ রানে হারিয়ে মূলপর্বে টানা হারের বৃত্ত ভেঙেছিল বাংলাদেশ। এবার সেই রেকর্ড ভেঙে ১৭ বছর পর বিশ্বকাপের সুপার এইটে খেলেছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। তবে, প্রথমবার সেমিতে খেলার যে স্বপ্ন তা আর পূরণ হয়নি বাংলাদেশের।
রাওয়ালপিন্ডিতে ইতিহাস
ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও আফগানিস্তানের কাছে হারে বিশ্বকাপের সুপার এইটে থামতে হয় বাংলাদেশকে। সেই ব্যর্থতা ভুলে আগস্টে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে নয়া ইতিহাস গড়ে লিটন দাসরা। ২৩ বছর অপেক্ষার পর অবশেষে পাকিস্তানকে টেস্টে হারাতে পেরেছে বাংলাদেশ। দেশের বাইরে বাংলাদেশের মাত্র দ্বিতীয় সিরিজ জয় এটি। তবে পূর্ণ শক্তির কোনো দলের বিপক্ষে এটিই প্রথম। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ২-০ ব্যবধানে জিতলেও সেবার চুক্তি সংক্রান্ত ঝামেলায় খেলেননি শীর্ষ ক্রিকেটারদের কেউ। বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছিল দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে।
বিসিবিতে রদবদল
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিবর্তনের হাওয়া বইছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দায়িত্ব নিয়ে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের। এরই অংশ হিসেবে বড় রদবদল দেখা গেছে বিসিবিতে। সভাপতির দায়িত্ব নেন সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। বোর্ডে যুক্ত হন নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতো পরিচিত মুখ।
আলোচিত-সমালোচিত সাকিব
প্রতিবছরের মতো এবারও বিতর্ক এড়িয়ে চলতে পারেননি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যখন দেশজুড়ে সহিংসতা ও প্রাণহানীর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে চলছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তখন পরিবার নিয়ে কানাডায় অবকাশ যাপনের ছবি দিয়ে তোপের মুখে পড়েন সাকিব। এমনকি পুরো আন্দোলনজুড়ে তার নিরব ভূমিকা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করলেও তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। নানা নাটকীয়তার পর গেল অক্টোবরে দেশে ফেরার চেষ্টা করলেও সমর্থকদের তোপের মুখে সেটা সম্ভব হয়নি।
ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভরাডুবি
প্রায় ৪ বছর পর সিরিজ খেলতে ভারত সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে, দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে পর তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে লড়াই করার সুযোগই পায়নি বাংলাদেশ। হোয়াইটওয়াশের লজ্জা নিয়ে দেশে ফেরে নাজমুল শান্তর দল। এরপরই অক্টোবরে দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। ভেন্যু বদলালেও সাফল্যের দেখা পায়নি ক্রিকেটাররা।
আফগানদের কাছে সিরিজ হার
ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের রেশ আফগানিস্তানের বিপক্ষেও কাটাতে পারেনি বাংলাদেশ। দুবাইয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও হতাশ করে বাংলাদেশ। অথচ এই ওয়ানডেতে একটা সময় ফেবারিট ছিল বাংলাদেশ। সময়ের সাথে পছন্দের সেই ফরম্যাটেও ছন্দ ধরে রাখতে ব্যর্থ লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। এর আগে ২০২৩ সালেও চট্টগ্রামে আফগানদের বিপক্ষে সিরিজ হেরেছিল বাংলাদেশ।
হাথুরুসিংহের বিতর্কিত বিদায়
অর্জনে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল কোচ হলেও তাকে নিয়ে বিতর্কের অন্ত ছিল না। চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে ঘিরে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই। একের পর এক বিতর্কের রেশ ধরে মোটাদাগে সামনে এসেছে ভারতে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে ক্রিকেটার নাসুম আহমেদের সঙ্গে অসদাচরণের বিষয়টি। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে তাকে বরখাস্ত করা হয়। নানা অভিযোগ থাকার পরও হাথুরুর ব্যাপারে কঠোর হতে পারেনি নাজমুল হাসান পাপনের অধীনে থাকা আগের কমিটি। ফারুক আহমেদ বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার দুমাস পেরোতেই নেন কঠিন সিদ্ধান্ত। অন্তবর্তী কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ক্রিকেটার ফিল সিমন্স।
তারুণ্যে চড়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে সিরিজ জয়
জাকের আলীর ব্যাটিং নৈপুন্যে দ্বিতীয় টেস্টে ড্র করে কোনোমতে সিরিজ বাঁচালেও ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা পায় বাংলাদেশ। ধারণা করা হচ্ছিল টি-টোয়েন্টিতেও ধরাশায়ী হবে সফরকারীরা। তবে, সবাইকে অবাক করে ক্যারিবীয়দের হোয়াইওয়াশের লজ্জায় ডুবিয়ে বছরের শেষটা রাঙাল বাংলাদেশ। যদিও এই সিরিজে ছিলেন না মুশফিকুর রহিম, নাজমুল শান্তর মতো অভিজ্ঞ তারকারা। তারুণ্যে চড়ে এমন সাফল্যে নিঃসন্দেহে নতুন আশা জোগাচ্ছে।
নারী ক্রিকেটে হতাশা
এই বছরটা মোটেও ভালো যায়নি নারী ক্রিকেটে। মার্চে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজে পায় হোয়াইটওয়াশের লজ্জা। পরাজয়ের সেই ধারা অব্যাহত থাকে ভারতের বিপক্ষে সিরিজেও। সাফল্য আসেনি মহিলাদের এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও। আর বছরের শেষে ঘরের মাটিতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে সিরিজ জিতলেও টি-টোয়েন্টিতে পায় হোয়াইওয়াশের লজ্জা। সবমিলিয়ে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী নারী ক্রিকেটে।
এশিয়ার সেরা যুবারা
ক্রিকেটে সেরা সাফল্য এসেছে যুবাদের হাত ধরে। চলতি মাসে অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের করে নেয় বাংলাদেশ। এর আগে, ২০২৩ সালে রাব্বি-শিবলীদের হাত ধরে প্রথমবার শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। সামনে বিশ্বকাপ, সেখানেও সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে মরিয়া লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।