লাভার বৃষ্টি বিকেল
ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি, কালিম্পং হয়ে যখন লাভা বাজারে পৌঁছালাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কিন্তু সারাদিন ধরে ঝরে পরা বৃষ্টি, মেঘে ঢাকা আকাশ আর পুরো ন্যাওরাভ্যালি অরণ্যে জেঁকে বসা কুয়াশা দেখে মনে হলো যেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সন্ধ্যা না, বিকেল মাত্র। তখন ঘড়িতে ৪টা বাজে।
জিপ থেকে নেমেই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ছোট-ছোট ইট-পাথরের বাড়িগুলোতে ঢুঁ মারতে থাকলাম রাতের ঠিকানা খুঁজে পেতে, তাও যতটা সম্ভব কম খরচে। কিন্তু এমন অনেক লজ থাকা সত্ত্বেও কোথাও থাকার তেমন জায়গা খুঁজে পেলাম না, ট্যুরিস্ট মৌসুম না হওয়ার কারণে। কারণ এই সময় এই অঞ্চলে সাধারণত কেউ বেড়াতে আসে না। তাই সবাই ট্যুরিস্টদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরগুলো অন্য কাজে লাগিয়ে রেখেছে। যে কারণে খালি বা ট্যুরিস্টদের দেওয়ার মতো কোনো পরিচ্ছন্ন বা উপযোগী ঘর দিতে পারল না। আর খাবারের হোটেল তো নেইই।
তাহলে এখন কী হবে? থাকব কোথায় আর খাব কী? সেই চিন্তায় বেশ খানিকটা হতাশ হয়ে ভেজা রাস্তার এক পাশে বসে পড়লাম। আর সব সময়ের জন্য ব্যাগে রাখা নিরাপত্তা সরঞ্জাম থেকে বের করলাম কেক আর কোক। এই দিয়েই আপাতত পেট ঠাণ্ডা করি, তারপর কোনো না কোনো উপায় খুঁজে বের করব ইনশাআল্লাহ। বেশ সময় নিয়ে আর আয়েশ করে কেক আর কোক দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ শেষ করে আবার থাকার জায়গা খুঁজে বের করতে হাঁটা শুরু করলাম।
এবার লাভা বাজার থেকে একটু নিচে নেমে যেতে শুরু করলাম। একটু সামনে এগিয়ে কয়েকটি জায়গায় খুঁজতেই একজন নিজে এসে রুম চাই কি না জানতে চাইলেন। বাহ বেশ তো, বলাতে তিনি কাঠের দোতালায় একটি রুম দেখালেন। সাথে বেশ বড় বাথরুম, গরম পানি, টিভি (অচল ছিল), জানালা দিয়ে পাহাড়ের সারি দেখা যায় এমন একটি রুম দেখালেন। আমি তো মনে মনে মহা খুশি, যাক থাকার জায়গা পাওয়া যাবে বা গেছে। আর একটু শঙ্কিতও এই ভেবে যে ভাড়া না যেন কত নেয় কে জানে?
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ৬০০ টাকা ভাড়া চাইলেন। আমি তো মনে মনে খুশি। তবুও বাঙালির স্বভাবগত দরদাম তো একটু করতেই হয়, নইলে মান থাকে না। ৪০০-তে রফা করলাম আর কেয়ারটেকারকে ৫০ দিয়ে মোট ৪৫০ টাকায় বেশ ভালো একটু রুম নিয়ে নিলাম। এরপর উষ্ণ পানিতে আরামদায়ক গোসল আর হালকা বিশ্রাম নিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে বাইরে বের হলাম। টিপটিপ বৃষ্টিটা তখনো পড়ছে। কিন্তু এমন মোহময় পাহাড়ি বিকেল, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমাকে রুমে আটকে রাখবে সে সাধ্য কার আছে? তাই বেরিয়ে পড়লাম বৃষ্টি উপেক্ষা করে।
দুপাশের পাহাড়ি ঘরবাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছি। একটু নামতেই চোখে পড়ল লাভার বর্ণিল মনেসট্রি। গেট খোলাই ছিল, তাই কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লাম। গেটেই পেয়ে গেলাম স্থানীয় একটি ছেলেকে, যে শিলিগুড়িতে পড়াশোনা করে, কলেজ বন্ধ থাকায় বেড়াতে এসেছে। ওর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখলাম লাভার দৃষ্টিনন্দন মনেসট্রি, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অপূর্ব কারুকাজের স্থাপনা, ছাত্রদের থাকা, পড়া, খাওয়ার আলাদা, আলাদা জায়গা। এরপর সেই বৃষ্টির মাঝেই হেঁটে রওনা হলাম লাভার মনেসট্রির চূড়ায় উঠতে। পিচঢালা আর পিচ্ছিল রাস্তা ধরে। অপূর্ব একটি রাস্তা পাহাড়ের পিঠ কেটে বানানো হয়েছে। দূরে পাহাড়ের সিঁড়ি দাঁড়িয়ে আছে স্তরে স্তরে। আকাশ মেঘলা না থাকলে ওখান থেকেই দেখা যায় দূরের বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছেলেটি জানাল।
সেখান থেকে দূরে দেখা যাচ্ছিল, আমাদের জন্য ভীষণ কাঙ্ক্ষিত আর দুর্লভ সিকিমের পাহাড়, গ্রাম, রাস্তা, ছোট ছোট গাড়ির ছুটে চলা, ছোট-মাঝারি আর বড়-বড় সব পাহাড়ের সারি হিমালয়ের সঙ্গে বন্ধু হয়ে। হেঁটে যাচ্ছিলাম, আর দূর থেকে সেসব পাহাড় দেখে মনের আক্ষেপে পুড়ছিলাম। কেন যে যেতে দেয় না আমাদের সেই বেদনায়। সেই অপূর্ণতাকে নিমিষেই পূর্ণতা দিয়েছিল লাভা মনেসট্রির পাহাড় চূড়া, ঝুম বৃষ্টি, কফি আর অনেক দিনের লালিত একটা ছোট্ট কিন্তু দুর্লভ স্বপ্ন। কীভাবে?
প্রায় ১০-১৫ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম মনেসট্রির চূড়ায়। যেখানে আমাকে অভিভূত করেছিল একটি কফিশপ। ভাবতেই পারিনি এখানে, লাভার এই প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের এই পাহাড় চূড়ায় দেখা মিলবে কোনো কফি শপের, আর সেখানে পাওয়া যাবে ধোঁয়া ওঠা চনমনে উষ্ণ কফি। আহ, আমাকে আর পায় কে? কত দিনের মনে মনে লালিত ক্ষুদ্র কিন্তু ভীষণ দুর্লভ একটা স্বপ্ন এভাবে হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়েছে বলে।
স্বপ্নটা এমন ছিল... একদিন কোনো এক পাহাড়ের চূড়ায় বসে ঝুম বৃষ্টি দেখব, বৃষ্টির পানিতে হাত ছোঁয়াব, একটি ছাতা মাথায় নিয়ে সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে ঝুম বৃষ্টির সঙ্গে হাতে নেব ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ, আর ঠোঁটে ছোঁয়াব গরম কফির মাদকতাময় স্বাদ!
ঠিক সেই অপার্থিবতা যেন নেমে এসেছিল এই পার্থিবতায়, যখন হাতে নিয়েছিলাম একমগ ধোঁয়া ওঠা কফি, মাথায় রেখেছিলাম ছাতা আর লাভার পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে বেরিয়েছিলাম ঝুম বৃষ্টিতে। আহ, সেই মুহূর্তটুকু যেন আমার কাছে এক টুকরো স্বর্গ ছিল। আর মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম বিধাতার কাছে, এই জন্মের কাছে, পৃথিবী, পাহাড়, বৃষ্টি আর এমন বর্ণিল আর নান্দনিক একটা জীবনের কাছে। জীবনটা সত্যিই সুন্দর, ভীষণ উপভোগের আর দারুণ আশীর্বাদের, যদি চাওয়া-পাওয়া হয় অল্প আর আনন্দ খুঁজে নিতে পারি যেকোনো কিছুতে।