শীতে ঘোরাঘুরি
পাহাড় বেয়ে মনিপুরে
ঝরনার কলতান
সবার আলোচনা ‘মেঘ দেখেছি আর ক্লান্তি নাই’। আবদুল ধন্যবাদ তোমাকে। কিন্তু এ কি! পাহাড়ি রাস্তার ওপরে পাহাড় থেকে ঝরনার জল পড়ে রাস্তা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। পাথরের পাহাড়ের উপস্থিতিও দেখলাম। কয়েকবার জিপ থামালাম। ইচ্ছেমতো মাখলাম ঝরনার কান্না। কিন্তু কত। মিনিট পাঁচেক পর পর ঝরনার আগমন ও পেছনে ফেলে চলে যাওয়া। বিধাতা কি তাহলে নিজ হাতে সাজিয়েছেন এসব কিছু। স্বচ্ছ ও হিম শীতল ঠান্ডা ঝরনার ভেজা হাওয়ায় যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে চাইছে সবাই। পাহাড়ের কন্যা ঝরনাধারার লোভাতুর দৃশ্য কি সহজে ছেড়ে আসা যায়। সামনে দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাবে তোমরা। নিরুপায় হয়ে চেপে বসলাম জিপে। সত্যিই তো ঝরনার যেন শেষ হচ্ছে না। ছোট-বড় শতাধিক ঝরনা চক্ষুগোচর হলো আমাদের। একসঙ্গে এত ঝরনা দেখার সৌভাগ্য সবারই এই প্রথম। একটার পর এটা আসছে ও পেছনে ফেলে চলছি। জিপের গ্লাসের ভেতর থেকে হা করে তাকিয়ে দেখছি। হাভাতে যেমনটি ভাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক হাজার মিটার উঁচু বলে পানির এই একটা উৎস পাহাড়ি অধিবাসীদের। পাইপ দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যার যেমন প্রয়োজন।
শত সৌন্দর্য পাহাড়ে
কয়েক হাজার ফুট ওপরে আমরা। এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার হয়তো সমুদ্রপিষ্ঠ থেকে আরো অনেক অনেক ওপরে আমরা ছুটে চলছি। পাহাড় বেয়ে পথচলা। নিচের দিকে তাকালেই হৃদয়ে শূন্যতা অনুভব হয়। এক পা ছিটকে পড়লেই মহাপ্রলয় পর্যন্ত খুঁজলেও আমাদের কেউ পাবে না। পাহাড়ি এ রাস্তা মূলত এক পাহাড় বেয়ে অন্য পাহাড়ে গিয়ে মিলেছে। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে সময় লেগেছে কয়েক ঘণ্টা। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে আমাদের জিপ ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার বেগে চলেছে। পাহাড়ের মাঝে মাঝে পাহাড়ি নদী ঘোলাটে পানি বহন করে সমুদ্রের প্রেমে যেন আজন্মই ছুটে চলছে নিজস্ব গতিপথে। নদীর ওপর দিয়ে এক পাহাড় দিয়ে অন্য পাহাড়ে কাঠের শক্ত ব্রিজ সংযোগ স্থাপন করেছে। সেই কাঠের ব্রিজ ডিঙিয়ে চলছে সব গাড়ি। পাহাড়ের ভাজে ভাজে বাড়িঘর ও জনবসতি। খুবই ছন্নছাড়া। যেন ছন্নছাড়াদের মিলনমেলা এই আসামের পাহাড়ে।
আর কতদূর
‘পথ শেষ হবে কবে রে আবদুল?’ সবার প্রশ্ন। ধুর ছাই কে শোনে কার কথা। আবদুল বুঝলেই ‘না’ বলবে। যতটুকু বোঝে তা ইশারায়। এই প্রথম মনে হয় ভাষাগত দক্ষতা কাজে লাগাতে পারলাম না। রাত ১০টায় জিপে উঠে সকালে মাইলফলকে দেখলাম ইম্পাল আরো ২১৫ কিলোমিটার। ‘আবদুল তাহলে আট ঘণ্টা কী করলি রে!’ এখনো এত বাকি। পথ যেন শেষই হতে চায় না। তবে হলফ করে বলতে পারি কারো এতটুকু খারাপ লাগেনি। পাহাড়ের চূড়ায় বাজার, আধুনিক স্কুল ও বাড়িঘর সত্যিই আমাদের ভাবনার মধ্যে ভিন্ন অবস্থান তৈরি করে। এর মধ্যে আমাদের জিপ ঘণ্টাতিনেক ধরে আরো ওপরে উঠছে। আরো ওপরে। আমরা কি তাহলে সপ্তম আসমানে পৌঁছাব নাকি? বড় একটা পাহাড়ের চূড়া ডিঙিয়ে এলাম। দূর থেকে নিচে চোখে পড়ল নগরের ঘোলাটে উপস্থিতি। ‘ওই দেখ, বোধ হয় ইম্পাল এসে গেছি। হুররে।’ কিন্তু কী দেখছি আমরা। মাইলফলকে স্পষ্ট রেখা ইম্পাল ৫০ কিলোমিটার। তাহলে আমরা কত ওপরে। মোড় ঘুরতেই আবার ঝরনা দেখলাম।
বিরক্তিকর চেকিং
এর মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চেকিংয়ে পড়েছি গুনে গুনে ১৯ বার এবং রাজ্য পুলিশের চেকিংয়ে ছয়বার। প্রতি জায়গাতেই নেমে হেঁটে অতিক্রম করতে হয়েছে। বিদেশি শুনে চেকিংয়ের মাত্রা যেন এতটুকু কম নয়। বড্ড বেশি যেন। সহজেই আঁচ করা যায়, এত সুন্দর পাহাড়ি পরশে তাহলে বিপদেরও গন্ধ আছে। শত-শত বিছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী নাকি সংগ্রাম করছে। অবশ্য এত বিশাল পাহাড়ের মধ্যে তা একদমই অস্বাভাবিক নয়। এ জন্যই মোড়ে মোড়ে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। ভারতীয় সরকার তাদের দমাতে বেশ ঢাকঢোল বাজিয়েই আয়োজন চালিয়ে নিচ্ছে।
অবশেষে ইম্পাল
বিকেল সাড়ে ৪টায় ২০ ঘণ্টা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে আমরা ইম্পালে মনিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালাম। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে ৩৬ ঘণ্টারও বেশি সময় পথে কাটাতে হয়েছে আমাদের। মনে হয়েছিল যেন পৃথিবীর এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে যাচ্ছি আমরা। ক্লান্তি আমাদের জেঁকে বসেছিল কিন্তু রোমাঞ্চকর পথযাত্রা শেষ হওয়ায় মন বড্ড বেশি নাখোশ ছিল।
মনিপুর হলো উত্তর-পূর্বের ভারত একটি রাজ্য। মনিপুরের রাজধানী ইম্পাল। এই রাজ্যে মৈতেই, পাঙ্গাল (মুসলমান), নাগা ও কুকি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। এরা তিব্বতি-ব্রহ্ম ভাষাগোষ্ঠীর নানা ভাষার।
জলমলে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায়
সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা বলতে আমরা বুঝি বিভিন্ন ধাঁচের গান-নাচ এবং বিভিন্ন ঢঙের উপস্থাপনা। কিন্তু সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা কি কখনো বিভিন্ন খেলা ও কসরতনির্ভর হতে পারে? মনেই হয় না। তবে তা যদি হয় নিজস্ব সংস্কৃতির ধারার প্রবাহ তাহলে হয়তো মেনে নেওয়া যেতে পারে। সম্মেলনের শেষ সন্ধ্যায় মনিপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্য নিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি একটা পার্কে হয় সমাপনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটির প্রথমে মনিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গান দিয়ে শুরু হলেও বাদবাকি ১৭ আনাই ছিল বিভিন্ন কসরত। পর্বত বিস্তৃত মনিপুর রাজ্যের অধিবাসীদের জীবনাচার ফুটে ওঠে এ উপস্থাপনায়। তাদের নিজস্ব কৌশলে অতিমাত্রায় প্রতিরক্ষার মল্লযুদ্ধও মঞ্চে পরম্পরাহীনভাবে জায়গা করে নেয়। বাঁধা চোখে ধারালো তরবারি চালানো। সূঁচালো লোহার শিক ও তরবারির নলায় শরীরের সবটুকু ভর দিয়ে ভেসে থাকা তাদের কাছে একদমই অসম্ভবের বিষয় নয়। দুই হাতে কাঠি নিয়ে মোটা একখণ্ড গোল কাঠকে কীভাবে মিনিট দশেক ঘোরানো যায় মণিপুরে এ প্রথম দেখা। তবে সবচেয়ে শিহরিত বিষয়টি হলো ধারালো তরবারি হাতে মল্লযুদ্ধ। একজন একজনকে মোকাবিলা করতে পারে তবে দুই বা ততোধিক শত্রুকে ঘায়েল করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। তাদের এ মারকাটের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল আমরা চীন বা জাপানে আছি। কিন্তু না এটা মনিপুরিদের মোকাবিলার কৌশল। তারা বাস্তবে সত্যিই বড্ড কঠিন করে নিজেদের রক্ষায় পটু। এতক্ষণে ন্যূনতম ব্যবধানে একজনের কপাল কেটে গেল ধারালো অস্ত্রের কোপে। তারপরও থামবার নাম নেই। আর সবশেষে মানবঢালের সে কি খেলা! সে দৃশ্য মনে করলে নিজেকে শক্তিশালী মনে করার সাহস বাড়ে।
লকটক হ্রদে এক দুপুর
সম্মেলনের পরের দিন আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় সাইড সিং-এ গিয়েছিলাম। মনিপুরের রাজধানী ইস্পাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে কয়েকটা ছোট্ট মফস্বল পেরিয়ে বেড়িয়েছিলাম আমরা। দুপুরের শেষে উত্তরপূর্ব ভারতে সবচেয়ে বৃহত্তর হ্রদ লকটক-এ ঘুরে রেড়িয়েছি। মনিপুরের মইরং-এর কাছে এ হ্রদের অবস্থান। এ হ্রদ থেকেই সেচ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সঙ্গে সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরে বিশুদ্ধ পানযোগ্য পানি সরবারহ করা হয় হ্রদ থেকে।
লক অর্থ ‘ঝরনা’ এবং টক অর্থ ‘শেষ’— এমনটিই জেনেছি আমরা। সত্যি এখানেই যেন ঝরনার শেষ হয়েছে। বিশাল বিস্তৃত পাহাড়ের গোড়ায় ধরনী অশ্রু যেন এখানে এসেই থমকে গেছে। আকাশছুঁয়ে থাকা পাহাড়গুলো যেন পানির স্পর্শে মেঘের রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করছে। এ হ্রদকে কেন্দ্র করে ১ লক্ষ মানুষের বসতি রয়েছে, পরিসংখ্যান এমনটি বলে।
রুপি নিয়ে বিড়ম্বনা
রুপি নিয়ে ঢের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে আমাদের। একে তো সবাই আগরতলা থেকে ডলার এনডোর্স করতে পারিনি সময়ের অভাবে, তার ওপর ৫০০ ও এক হাজার রুপির নোট নিয়ে সেকি টালবাহানা। যে ডলার ৮৩ রুপিতে বিক্রি করা হয়, তা বিক্রি করতে হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ রুপিতে। বাংলাদেশের টাকা ৮৭ পয়সার বিক্রি করতে হয়েছে ৭০ রুপিতে। তা পুরো ইম্পাল শহর ঘুরে। হাপিত্তেশের মতো অবস্থা হলে যা হয় আর কি। এরপর ইম্পালের বাজার ঘুরে খুঁটিনাটি কেনাকাটা।
গন্তব্যের দিকে
১৩ নভেম্বর ইম্পাল থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় আমাদের ফ্লাইট। ১২ জনের দলে আমার মতো অনেকেরই প্রথমবার আকাশপথে যাত্রা হবে। আমার সে কি অজানা অনুভূতির টান। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেলা ১২টায় আমরা আগরতলার উদ্দেশে যাত্রা করলাম। নিচের মেঘ, মাঝের মেঘ ছাড়িয়ে আমাদের বিমান ওপরের মেঘেরও ওপরে উঠল। বিমানের জানালা দিয়ে মেঘের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা ইম্পালকে দেখলাম। জানালা দিয়ে সূর্যের তির্যক আলো চোখে পড়ছে পরম্পরাহীনভাবে। বুঝলাম কিছুটা হলেও সূর্যের কাছে এসেছি আমরা কিন্তু সূর্য তা মানতে চাইবে কেন? কিছুক্ষণ পরেই চোখে পড়ল পাহাড়ের দেশের উপস্থিতি। ঘন জঙ্গল পাহাড়ের গায়ে জেঁকে বসে আছে। এখানে কত হাজার বৃক্ষের যে বেড়ে ওঠা ও শেষে মৃত্যু, তার ইয়াত্তা নেই। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে পাহাড়ি নদীগুলো। কি রকম মোটা দাগ ফেলে শিল্পীর তুলির মতো একেবেঁকে চলে গেছে চিরদিনের পথে। অজানা পথে, কেউ জানে না সে পথের শেষ কোথায়। যাওয়ার দিন যে পাহাড়গুলো বেয়ে আমরা শত ক্লান্তি ও রোমাঞ্চকরের মধ্য দিয়ে ইম্পাল গিয়েছিলাম, সেই পাহাড়ের স্পর্শ ছাড়াই এবার আমাদের পথ অতিক্রম হচ্ছে। এতে মনে হয় বড্ড অভিমান হয়েছে পাহাড়গুলো। তাই তো মুখ ভার করে বোকা সেজে আছে পর্বতমালা। সাধ্য থাকলে এখনই নেমে গিয়ে ওদের মায়ার ছায়ায় চলতাম। এত অভিমান ওদের। মনে মনে বললাম, এবারের মতো অভিমান করো না। পরে যখনই আসব তখন তোমাদের আয়োজনেই চলব। কিন্তু অভিমান ভাঙছে না তাদের। পরে বললাম, আচ্ছা পরেরবার তো হৃদয়স্পর্শী বিশ্বমাধুরী প্রেমললনা প্রিয়তমা ‘আত্রলিতা’কে নিয়ে আসব তোমাদের মাঝে।
সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে মাত্র ৪০ মিনিট লাগল। এর মধ্যে মনিপুরের কত-শত প্রকৃতি দেখা হয়েছে। আর কত-শত বাকি রয়ে গেল। ছোট্ট রাজধানীতে আবারও হয়তো একসময় পদচিহ্ন ফেলব। আগরতলা ওই দিনের বাকিটা ও রাত কাটিয়ে পরদিন দেশে এলাম। ১৪ তারিখ সন্ধ্যায় যখন বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে মাইক্রোবাসে করে কুমিল্লার পথ ধরেছি তখন আমার প্রিয় বন্ধুটি বলল, ‘সব অনিশ্চয়তা শেষ। এবার নিশ্চিত গন্তব্যে আমরা।’ আমার খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছিল যে আমাদের যাত্রা তো অনিশ্চিত ছিল না। কিন্তু না থাক। সব কথার কি আর মানে বের করা যায়।