ছুটির দিনে
ঘুরে আসুন ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলে
পড়ন্ত বিকেল। ঝিরঝির হিমেল হাওয়া বইছে। শীতের এই সময়ে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক স্থান আহসান মঞ্জিলে ঘুরতে এসেছেন দর্শনার্থীরা। প্রতিদিনই এখানে রয়েছে ভ্রমণপিয়াসীদের আনাগোনা। এ ছাড়া ছুটির দিনে হাজারো মানুষের ঢল নামে নবাব আমলের এই স্থাপত্য দেখতে।
ঢাকা শহরের মতো ব্যস্ত শহরে নিশ্বাস ফেলার জায়গার অভাব। কিন্তু আপনি চাইলেই আহসান মঞ্জিলের মতো একটি ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরে আসতে পারেন।
চলুন তাহলে এবার
পাটুয়াটুলীর রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি অলিগলি পার হওয়ার ঝামেলা এখানে খুব একটা পোহাতে হয় না। বামে মোড় নিয়ে ওয়াইজঘাটের রাস্তা ধরে হাতের বামে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ফেলে সোজা তাকালে চোখে পড়বে একটি লাল রঙের প্রাসাদ। এটিই আহসান মঞ্জিল। কাছে গিয়ে ২০ টাকায় টিকেট কেটে ঢুকলেই বিশাল উদ্যান। অনেক রকমের ফুলগাছ, পাতাবাহার, নারিকেল আর সুপারিগাছে ভরা সবুজ অঙ্গন। মনমাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বাতাসে ফুলের সুবাস, সামনে প্রাচীন প্রাসাদ মুহূর্তেই নিয়ে যায় কোনো এক কল্পনার রাজ্যে। প্রেয়সীর হাত ধরে মৃদু পায়ে হেঁটে চলা। এভাবেই সপ্তাহের ছয়দিনই প্রাণের স্পন্দন জাগে আহসান মঞ্জিলে।
প্রকৃতি ছেড়ে এবার প্রাসাদের দিকে যাওয়া যাক। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে তখনকার জামালপুর পরগনার (বর্তমান ফরিদপুর-বরিশাল) জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ রংমহল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর জমিদারের ছেলে শেখ মতিউল্লাহ এটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন।
১৮৩৫ সালের দিকে বেগম বাজারে বসবাসকারী নবাব আবদুল গনির বাবা খাজা আলীমুল্লাহ এটি কিনে নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৭২ সালে নবাব আবদুল গনি নতুন করে নির্মাণ করে তাঁর ছেলে খাজা আহসানউল্লাহর নামে ভবনের নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল।
এটি একটি দোতলা ভবন। বারান্দা ও মেঝে মার্বেল পাথরে তৈরি। প্রতিটি কক্ষের আকৃতি অষ্টকোণ। প্রাসাদের ভেতরটা দুই ভাগে বিভক্ত। পূর্বদিকে বড় খাবার ঘর। উত্তরদিকে লাইব্রেরি। পশ্চিমে জলসাঘর। পুরো ভবনের ছাদ কাঠের তৈরি। নিচতলায় খেলার ঘরে রয়েছে বিলিয়ার্ড খেলার জন্য আলাদা জায়গা। দরবার হলটি সাদা, সবুজ ও হলুদ পাথরের তৈরি। দোতলায় বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার আর তিনটি মেহমান কক্ষ। পশ্চিম দিকে আছে নাচঘর আর কয়েকটি আবাসিক কক্ষ। আহসান মঞ্জিলের তথ্যকর্মীর কাছ থেকে জানা যায়, আহসান মঞ্জিলের ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টি কক্ষ বিভিন্ন প্রদর্শনীর জন্য, নয়টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা কোকারিজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র এবং নওয়াব এস্টেটের পুরোনো অফিস এডওয়ার্ড হাউস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা চার হাজার সাতটি।
এই ভবনটি ১৮৮৮ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ও ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহসান মঞ্জিলই ঢাকার প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য। যেখানে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা হয় নবাবদের হাতে। মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলী পশ্চিমাদের সব সময়ই আকৃষ্ট করত। লর্ড কার্জন ঢাকায় এলে এখানেই থাকতেন। বাংলাদেশ সরকার আহসান মঞ্জিলকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করে। ১৯৯২ সালে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দর্শনার্থীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে দূর-দূরান্ত থেকে বেড়াতে এসেছে আহসান মঞ্জিলে। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি ছবি তুলছে অনেকে।
মাহিয়া আলম তাঁর পরিবারসহ ঘুরতে এসেছেন। এনটিভি অনলাইনকে জানান, প্রতিদিন তিনি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাই ছুটির দিনে সবাই মিলে ঘুরতে এসেছেন এখানে। হাতের কাছেই রয়েছে এরকম একটা ঐতিহাসিক স্থান, তাই তিনি এ প্রাসাদ সম্পর্কে তাঁর বাচ্চাদের জ্ঞান দিতে ও বিনোদিত করার জন্য আহসান মঞ্জিলে বেড়াতে এসেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শারমীন সোহানা বলেন, তাঁর বন্ধুর সঙ্গে এখানে প্রথম ঘুরতে এসেছেন। তিনি বলেন, এটা থেকে অনেক কিছু জানতে পেরেছি আগে। বইপুস্তকে পড়েছি, এবার নিজের চোখে দেখতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।
জাদুঘরে যা দেখবেন
গ্যালারি ১ : এখানে আহসান মঞ্জিলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আলোকচিত্র ও চিত্রকর্মের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া আছে ভবনের একটি মডেল।
গ্যালারি ২ : বিভিন্ন সময়ে ভবনের যে বিবর্তন হয়েছে তা আলোকচিত্রের সাহায্যে প্রদর্শন করা হয়েছে এখানে। এ ছাড়া আছে কাটগ্লাস ও ঝাড়বাতির নমুনা।
গ্যালারি ৩ : নবাবদের আনুষ্ঠানিক ভোজন কক্ষ। এখানে প্রদর্শিত হয়েছে আলমারি, আয়না, কাচ ও চিনামাটির তৈজসপত্র। সবই আহসান মঞ্জিল থেকে প্রাপ্ত নির্দশন।
গ্যালারি ৪ : বড় কাঠের সিঁড়ি। হাতির মাথার কঙ্কাল, ঢাল-তলোয়ার। কাঠের বেড়ার মূল নিদর্শন।
গ্যালারি ৫ : আসল ঢাল-তলোয়ারের অনুরূপে সাজানো।
গ্যালারি ৬ : আহসানউল্লাহ মেমোরিয়াল হাসপাতালের বেশকিছু ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ও খাতাপত্র এই কক্ষে প্রদর্শিত হয়েছে।
গ্যালারি ৭ : এই বড় কক্ষটি নবাবদের দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনের সময় শাহবাগের সম্মেলনে আসা সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের তৈলচিত্র এই গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া আছে ঢাকার নবাবকে ইতালি থেকে দেওয়া একটি অষ্টকোণ টেবিল।
গ্যালারি ৮ : এডওয়ার্ড হাউস থেকে সংগৃহীত জীবজন্তুর শিং। এ ছাড়া সেই সময়ে ঘরের বাইরে ও ভেতরে খেলার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
গ্যালারি ৯ : বড় লোহার সিন্দুকসহ অন্যান্য সিন্দুক ও কাঠের আলমারিগুলো নবাবদের আমলের নিদর্শন।
গ্যালারি ১০ : এখানে আছে বড় বড় আলমারি, তৈজসপত্র যা নবাবের আমলের নিদর্শন।
গ্যালারি ১১, ১২ ও ১৩ : এই গ্যালারিগুলোতে যথাক্রমে বরেণ্য ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি, স্যার সলিমুল্লাহ স্মরণে এবং নবাবদের সমসাময়িক মনীষীদের প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে।
গ্যালারি ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ : যথাক্রমে হিন্দুস্তানি কক্ষ, প্রধান সিঁড়িঘর, লাইব্রেরি কক্ষ ও তাসখেলার ঘর।
গ্যালারি ১৮ ও ১৯ : ঢাকায় পানীয় জল সরবরাহবিষয়ক নিদর্শন যেসব আহসান মঞ্জিল ও এডওয়ার্ডস হাউসে পাওয়া গেছে। ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কের কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য ছবি এখানে আছে।
গ্যালারি ২০ ও ২১ : ১৯০১ সালের আগে ঢাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল না। নবাবের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করার তথ্য, তৈজসপত্র ও ফুলদানি সবই নবাবের আমলের।
গ্যালারি ২২ : দোতলায় অবস্থিত এই গ্যালারিতে আহসান মঞ্জিলে থেকে পাওয়া অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে। উঁচু গম্বুজটি এই ঘরের ওপরেই অবস্থিত।
গ্যালারি ২৩ : এটি ছিল নাচঘর। ১৯০৪ সালে তোলা ছবি অনুযায়ী এটি সাজানো হয়েছে।
সব কটি গ্যালারি ঘুরে পাশেই নবাববাড়ির পুকুর দেখে আসা যাবে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে গুলিস্তান এসে নর্থ সাউথ রোড ধরে কিছুদূর গেলেই পড়বে নয়াবাজার মোড়। এখান থেকে বাবুবাজারের দিকে যেতে থাকবেন। বাবুবাজার ব্রিজের বামপাশে নিচ দিয়ে গেলে পড়বে আরেকটি মোড়। এর বামপাশে গেলেই ইসলামপুর। এখানে এসে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বাতলে দেবে আহসান মঞ্জিল যাওয়ার রাস্তা।
দর্শনার্থীদের প্রবেশের সময়সূচি
সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতিবার। এ ছাড়া অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনেও বন্ধ থাকে।
গ্রীষ্মকালীন সময়সূচি : (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর)-(শনিবার-বুধবার) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা। শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।
শীতকালীন সময়সূচি : (অক্টোবর –মার্চ) - (শনিবার-বুধবার) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা। শুক্রবার – দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।
টিকেটের মূল্য তালিকা
প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি দর্শক = ৫ টাকা জনপ্রতি, অপ্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি শিশু দর্শক (১২ বছরের নিচে)= ২ টাকা জনপ্রতি, সার্কভুক্ত দেশীয় দর্শক = ৫ টাকা জনপ্রতি, অন্যান্য বিদেশি দর্শক = ৭৫ টাকা জনপ্রতি। উল্লেখ্য যে, প্রতিবন্ধী দর্শকদের জন্য কোনো টিকেটের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া আগে আবেদনের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে জাদুঘর প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।