ঘোরাঘুরি
চলুন যাই বিউটি বোর্ডিংয়ে
বুড়িগঙ্গা নদীর কাছাকাছি অবস্থিত বাংলাবাজারের শ্রীশ চন্দ্র দাস লেনে মোড় নিলেই চোখে পড়ে ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং। রংচটা হলদে দেয়াল ও শ্যাওলাপড়া দোতালা বাড়িটি খুব সাধারণ একটি বাড়ি মনে হলেও এটি বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও ইতিহাসের এক ভিত্তিভূমি। দেশবরেণ্য কবি শামসুর রহমান যার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মনে পড়ে, একদা যেতাম/ প্রত্যহ দু’বেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই/ বিউটি বোর্ডিং-এ পরস্পরের মুখ দেখার আশায়/ আমরা কজন।’
বিউটি বোর্ডিংয়ের ইতিহাস
বিউটি বোর্ডিংয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্বল্প কথায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। শুরুটা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। এর প্রতিষ্ঠাতা মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা। তাঁর দুই ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহার বর্তমানে এটির মালিক। তাঁদের তথ্য থেকে জানা গেল এর ইতিহাস। প্রহ্লাদ সাহা ১৯৪৯ সালে বিউটি বোর্ডিংয়ের গোড়াপত্তনের পূর্বে এটি ছিল ঐতিহাসিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার কার্যালয়। তখন এখানে ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বিপ্লবীদের আনাগোনা। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অনেক বিপ্লবী এখানে বসেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে সাজাতেন তাঁদের কর্মপরিকল্পনা। নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুও এখানে এসেছিলেন ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার কার্যালয়ে। দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালে ‘সোনার বাংলা’ প্রেসের মালিক সুধীর চন্দ্র দাসের কাছ থেকে জায়গাটুকু নিয়ে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও তার ভাই নলিনী মোহন সাহা দুজনে মিলে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। বিউটি বোর্ডিং এর জন্মলগ্ন থেকেই জমে উঠতে থাকে খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের আড্ডা। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনারা বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ সময় বিউটি বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার ও বোর্ডারসহ প্রায় ১৭ জনকে হত্যা করে পাকবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এর অবস্থা এক রকম ভেঙে পড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রহ্লাদ সাহার স্ত্রী তার দুই ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহাকে নিয়ে পুনরায় চালু করেন বোর্ডিং ব্যবসা। বর্তমানে প্রহ্লাদ সাহার দুই ছেলে এর যাবতীয় বিষয় দেখভাল করেন।
বিউটি বোর্ডিং এর বর্তমান অবস্থা
‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ এমন গানের সুরেই বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা যায়। আগের মতো কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের আনাগোনা নেই। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সেই সোনালি সময়ের বেশির ভাগ ব্যক্তিত্ব। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আগের মতোই টিকে আছে বিউটি বোর্ডিংয়ের দোতালা বাড়িটি। এর অফিস কক্ষটির দেয়ালজুড়ে রয়েছে বেশ কিছু পুরোনো ছবি। ধুলোজমা ছবিগুলোও এখন ইতিহাসের সাক্ষী।
আছে থাকার ব্যবস্থা
বিউটি বোর্ডিংয়ে আগের মতোই এখনো রয়েছে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। তবে খাবার ঘরের পরিবেশ আপনার পছন্দ নাও হতে পারে। খাবার তৈরি ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে নিজস্ব ঐতিহ্য এখনো অটুট রয়েছে। খাবার ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি টেবিল-চেয়ার। টেবিলে সাজানো স্টিলের থালা আর গ্লাস। দেয়ালে টাঙ্গানো আছে পুরোনো কিছু ছবি ও খাবারের মূল্য তালিকা। বিউটি বোর্ডিংয়ে বর্তমানে ২৭টি আবাসিক কক্ষ রয়েছে। এগুলোর কোনোটি সিংগেল বেডের আবার কোনোটি ডাবল বেডের। এগুলোর ভাড়া ২৫০ থেকে শুরু করে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে এখানে দু-এক রাত কাটিয়ে আসতে পারেন আপনিও।
খাওয়া-দাওয়া
মেনুতে ভাতের সঙ্গে শাক সবজির পাশাপাশি এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাংস। এখানে মুরগির মাংস ১১০ টাকা, ইলিশ মাছ ১০০ টাকা, রুই মাছ ১৩০ টাকা, ফলি মাছ ১১০ টাকা, কৈমাছ ১০০ টাকা, খল্লা মাছ ৮০ টাকা ও বাইলা মাছ ১১০ টাকা মূল্যে পাওয়া যায়। এ ছাড়া এখানে ৩০ টাকা মূল্যে দই পাওয়া যায়।
যেভাবে যাবেন
গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে খুব সহজেই বাস বা রিকশায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাবাজারের বইপাড়ায় চলে আসতে পারেন। এতে খুব বেশি সময় প্রয়োজন হবে না আপনার। সেখানে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে বিউটি বোর্ডিং।