ছুটির দিনে
ভাসমান শহরে
ভূস্বর্গ বলা হয় কাশ্মীরকে। আর কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের মুকুট বলা হয় ডাল লেককে। কাশ্মীর শহরের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত টুরিস্ট স্পট ডাল লেক। স্বর্গীয় মুকুটে পুরো দিন আর রাত থাকতে কে না চায়? তাই নিশ্চিন্তে ঘুরে আসতে পারেন ডাল লেকের এক সকাল-বিকেল-সন্ধ্যারাতে।
ডাল লেকের অবস্থান
ডাল লেকের অবস্থান শ্রীনগর শহরের ঠিক মাঝখানে। লম্বায় ডাল লেক প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার আর প্রশস্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে পুরো ডাল লেক দেখতে আপনাকে ঘুরতে হবে ১৫-২০ কিলোমিটার। গভীরতা প্রায় পাঁচ ফুট থেকে কোথাও কোথাও ২০ ফুট পর্যন্ত।
ডাল লেকের চারপাশজুড়ে আছে নানা রকম দর্শনীয় মুঘল গার্ডেন, এদের মধ্যে অন্যতম শালিমার বাগ, নিশাত বাগ। আর ডাল লেকের শেষ প্রান্ত ঘেঁষে রয়েছে বিখ্যাত হজরতবাল মসজিদ। যেখানে হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর দাড়ি মোবারক সংরক্ষিত আছে। তবে বিশেষ বিশেষ দিনে এটা দেখার সুযোগ দেওয়া হয়।
যেভাবে আসবেন
শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে ডাল লেকের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। সময় লাগে ৩০-৩৫ মিনিট। আর যাঁরা জম্মু থেকে ডাল লেকে আসবেন, তাঁদের পাড়ি দিতে হবে ২৭০ কিলোমিটার। সময় লাগবে ছয় ঘণ্টা বা তার চেয়ে কিছু বেশি।
ভাসমান শহর এবং রঙিন সিকারা
ডাল লেকের প্রধান আকর্ষণ হলো এর পানিতে ভেসে থাকা হাউস বোট। ডাল লেকের আসল রূপ উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে থাকতে হবে হাউস বোটে আর ভাসতে হবে রঙিন সিকারায়। পুরো ডাল লেকটাই যেন এক ভাসমান শহর। কারণ শ্রীনগরের সব কর্মকাণ্ড বা ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত এই ডাল লেককে কেন্দ্র করে। সুতরাং ওদের সব আয়ের উৎস্য এই একমাত্র ডাল লেকে বেড়াতে আসা টুরিস্টরা।
হাউস বোট ও সিকারা
হাউস বোটে বসে বা সিকারায় ভেসে ভেসেই আপনি কিনতে পারবেন আপনার পছন্দের প্রায় সব রকম পণ্য । দামটাও বেশ নাগালের মধ্যে। শাল-পশমিনা-সালোয়ার কামিজ, কারুকাজ করা বেড কভার, গয়না, কাঠের নানা আসবাব ফুল-খাদ্য-মাছ-মাংসসহ পাবেন ভাসমান বাজারে। দোকান, রেস্টুরেন্ট এমনকি ভাসমান ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে মার্কেট পর্যন্ত সব আছে এই ভাসমান শহরে।
তবে সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে মনোরম হলো হাউস বোটে থাকা আর সিকারায় ভেসে বেড়ানো। প্রথমেই হয়তো হাউস বোট বা ডাল লেক আপনাকে মুগ্ধতায় পাগল করে দিতে পারবে না। কিন্তু ধীরে, ধীরে ফ্রেশ হয়ে, নাওয়া-খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে যখন হাউস বোটের সামনের খোলা কাঠের বারান্দা বা পাটাতনে চেয়ার পেতে বসবেন, তখন থেকে মুগ্ধতা ঘিরে ধরতে শুরু করবে আপনাকে।
নানা রঙের সিকারার শান্ত জলে বয়ে চলা, লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-বেগুনি আর গোলাপি, বর্ণিল ফুলে, ফুলে ভরা সিকারাগুলো ভেসে চলেছে এক হাউস বোট থেকে অন্য হাউস বোটে। এক হাউস বোটের সিঁড়ির কাছে, দূরে পাহাড়ের সূর্যের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা সঙ্গে নানা রঙের বদল ক্ষণে ক্ষণে, কখনো সবুজ, কখনো হলুদ আবার কখনো গোলাপির আভা, লেকের স্বচ্ছ পানিতে পাহাড়ের ছায়া, সিকারার রংবেরঙের ছাদগুলোর পানির নিচের নাচন, আর নানা রকমের ফলের বিকিকিনি চলছে।
আপনিও ভেসে বেড়াতে পারেন আপনার জন্য হাউস বোটের সঙ্গে বেঁধে রাখা সিকারায়।
সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে সূর্য হেলে পড়তেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে ঝলমলে ডাল লেক।
বিকেলে অন্য ডাল লেক। দুপুরে যেটা শুধু লালের ছোঁয়া ছিল, এখন সেটা শত রঙের খেলায় মেতে উঠবে, এক-এক জায়গায় সূর্যের এক এক রকম রং লেগে থাকবে। সবুজ পাহাড়ে হয়ে যাবে হলুদ রঙ, নীল পানিতে হবে মেরুন, দূরের সাদা পাহাড়ে হয়ে যাবে গোলাপি আর লাল। কাছে-পিঠের গাছে গাছে আলোর ঝলকানি থাকবে। অদ্ভুত রঙের খেলায় মেতে উঠবে পুরো ডাল লেক।
সন্ধ্যারাতে ডাল লেক যেন সেজে ওঠে তার আপন রূপে। ডাল লেককে পুরোপুরি উপভোগের সময়ই হলো সন্ধ্যা থেকে রাত। হাজারো আলোর ঝলমলে বাতি জ্বলে উঠবে শত শত হাউস বোটের সামনের কাঠের বেলকনিতে। এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের রূপ দেখতে পাবেন সন্ধ্যা আর রাতের ডাল লেকে। আলোয় আলোয় আলোকিত পুরো ডাল লেকের সব হাউস বোট, বর্ণিল ঝলমলে ফোয়ারা, স্বচ্ছ জলে হাজার রঙের ঢেউয়ের খেলা, আর ঝলমলে চারিদিক আপনাকে মুগ্ধ করবে।
সকালে এক সোনা মাখা হলুদাভ রূপ, দুপুরে সবুজে, ছায়ায়, পানিতে সূর্যের শত রঙের খেলা আর বিকেলে বা শেষের সন্ধ্যা থেকে রাতে এক অবর্ণনীয় সাঁজে থাকবে ডাল লেক।
থাকা-খাওয়ার খরচ
আপনি একটু কম খরচে আর কিছুটা নিজের মতো করে থাকতে চান তবে, একটি সিকারা ঠিক করে নিতে পারেন এক ঘণ্টার জন্য। যে কোনো হাউস বোটে পৌঁছে যাবেন কয়েক মিনিটের মধ্যে। যথেষ্ট ভালো আর আরামদায়ক, উন্নত মানের ডাবল বেডের হাউস বোট পাওয়া যায় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
লেক লাগোয়া হোটেলও পেয়ে যাবেন একই রকম দামে। সুতরাং দেখে-শুনে নিজেদের পছন্দমতো হাউস বোট বা হোটেলে উঠে পড়ুন।
খাবার-দাবার
শ্রীনগরের ডাল লেকে খাবার খরচটা ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে তুলনামূলক কিছুটা বেশি। খাবার খরচ জনপ্রতি ৩০০ টাকা প্রতিবেলা। চা বা কফি পাবেন ২০-২৫ টাকায়। ডিম ৬০ টাকা, সিঙ্গেল ভাত ৬০ টাকা, এমনি খাবারের সঙ্গে সালাদের দামও রাখবে আলাদা।
এর কারণ কাশ্মীরের নিজস্ব উৎপাদিত তেমন কিছু নেই, সব কিছুই দূরের কোনো প্রদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে খরচটা বেশি পড়ে দামটা বেশি হয়ে যায়। এখানে অবশ্য ওদের তেমন কিছু করার নেই।
ঢাকা থেকে ডাল লেক
ঢাকা থেকে কলকাতা। আর কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে শ্রীনগর বেশ কয়েকভাবেই যাওয়া যায়। ট্রেনে কলকাতা, কলকাতা থেকে জম্মু ট্রেনে। এরপর জম্মু থেকে শ্রীনগর জিপ বা প্লেনে অথবা এই তিন বাহনের যে কোনোটিতে যে কোনোভাবে আপানি যেতে পারেন।
খরচ
প্লেনে যেতে চাইলে আপনাকে অন্তত দুই মাস আগে টিকেট কেটে রাখলে কলকাতা থেকে শ্রীনগর যাওয়া-আসার রিটার্ন টিকেট পাবেন ১২ হাজার টাকার মধ্যে। যত দেরিতে কাটবেন, টিকেটের মূল্য তত বাড়বে। এটা খেয়াল রাখতে হবে আপনাকে। এমনকি কলকাতা থেকে ট্রেন আর জিপে করে গেলেও যাওয়া-আসা এসি সিটের ভাড়া পড়বে ১০ হাজার টাকা। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে যাওয়া যায় জম্মু হিমগিরি এক্সপ্রেসে। এসি থ্রি টায়ারের ভাড়া প্রায় ২৫০০ টাকা। এরপর গাড়ি ভাড়া ২৫০০-৬০০০ পর্যন্ত। কত সিটের গাড়ি নেবেন তার ওপর নির্ভর করবে ভাড়া। কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত রাজধানী এক্সপ্রেস আর দিল্লি থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে করেও জম্মু পর্যন্ত যেতে পারেন আপনি। ভাড়া দিল্লি পর্যন্ত ২৮৫০ টাকা খাওয়াসহ। আর জম্মু রাজধানীর ভাড়া ১৫০০ টাকা।
দালাল চক্র থেকে সাবধান
শ্রীনগরে আপনি যখন পৌঁছাবেন, সেটা এয়ারপোর্ট হোক বা সরাসরি জম্মু থেকে ডাল লেকের পাড়ে হোক, আপনার গাড়ি ঘিরে ধরবে অনেক হোটেল আর হাউস বোটের দালাল। জুন থেকে আগস্ট, শ্রীনগর এই সময়ে একদম ফাঁকা বা প্রায় টুরিস্টশূন্যই থাকে বলা যায়। তাই সবাই নিজের সুবিধামতো গন্ত্যব্যে নিয়ে যেতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
কারণ আপনাকে নিয়ে গিয়ে নিজেদের পছন্দের কোনো হোটেল বা হাউস বোটে তুলতে পারলেই ওদের কিছু কমিশন থাকে। তাই খুব শক্তভাবে ওদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে।