ঈদের ছুটিতে
রাজসিক রাজশাহী
রাজসিক শব্দটির মধ্যে একধরনের আভিজাত্য, নীরব সৌন্দর্য আর আতিথেয়তা আছে। আর এই সবকিছু শুধু রাজশাহীতেই পাওয়া সম্ভব। রাজশাহী দেশের এমন একটি শহর, যেখানে নীরবে, নিভৃতে, ঝামেলা ছাড়াই একান্ত কিছু সময় কাটানোর এক আদর্শ স্থান হতে পারে।
আপনার কখনো কখনো মনে হয় না যে নাগরিক জীবনের কোলাহল ছেড়ে কোনো নগরের মধ্যেই কাটিয়ে আসি কয়েকটা দিন। যেখানে সকল নাগরিক সুবিধাই থাকবে, ইচ্ছে হলেই পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় সবকিছু হাতের নাগালে। কিন্তু থাকবে না কোনো কোলাহল, ধুলো-বালি বা কালো ধোঁয়ার অসহ্যতা, বাস-ট্রাকের অবিরত হর্ন, থাকবে না শিল্প-কারখানার বর্জ্যদূষণের অবিরাম নিঃসরণ। যেখানে থাকবে না নিরন্তর জ্যামে বসে থেকে সময়কে অসময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়ার অনিচ্ছাকৃত মন খারাপ।
ঠিক এমন করেই যদি কোনো বেড়ানোর জায়গা পেতে চান তো নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারেন এক রাজসিক রাজশাহীতে। চলুন সেগুলো যেনে নিই একটু একটু করে।
আপনি শহরের মাঝেই পেতে চান অবিরাম বয়ে যাওয়া কলকল ধ্বনিতে মুখরিত, ঢেউয়ের দোলায় মনকে দুলিয়ে যাওয়া কোনো নদী? পাবেন পদ্মার তীরে গড়ে ওঠা রাজশাহীতে। ভরা বর্ষায় অসীম জলের অবিরাম ঢেউ, ঝিরঝিরে বাতাসে বসে থাকবেন টি-বাঁধ নামক পাথরের বাঁধের স্বচ্ছ কোনো পাথরের ওপর বা সবুজ ঘাসের ওপর।
শরতে পাবেন নদীর পাড়জুড়ে কাশফুলের এক নরম আর অসম্ভব আকর্ষণীয় সাম্রাজ্য। কাছে-দূরে জেগে থাকা ছোট-বড় বালুচর আর ক্ষুদ্র বনভূমি। আপনি তপ্ত বালুচরেও খুঁজে পেতে পারেন এক অন্য রকম ভ্রমণ আনন্দ; যা আপনাকে এনে দেবে একেবারেই ভিন্ন স্বাদের কোনো রোমাঞ্চ।
আর শীতে পাবেন দেশের মধ্যে মরুভূমির স্বাদ। নদী তখন পানিহীন এক ধু-ধু মরুভূমিসম। যত দূর চোখ যায় শুধু শুকনো নদী, বালুচর আর তপ্ত রোদের উত্তাপ। হেঁটে বেড়িয়ে পেতে পারেন যে কোনো মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর সত্যিকারের রোমাঞ্চ। গিয়েই দেখুন না একবার।
এরপর রয়েছে রাজসিক রাজশাহীর সবচেয়ে আকর্ষণ, বনভূমি আর অরণ্যে আচ্ছাদিত অসম্ভব নান্দনিক সাজে সব সময় সেজে থাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ছাড়া আর তেমন কোনো কিছুই চলে না, সেও দিনে দুই বা তিনবার। আর আছে একমাত্র বাহন রিকশা। যে রিকশায় চড়ে বা পায়ে হেঁটেই দেখে নিতে পারেন পুরো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে; যদি সারা দিন বা অন্তত একটা বেলা বরাদ্দ রাখেন এই স্বর্গীয় অরণ্যেঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের শুরুতেই সবুজের গালিচা-মোড়া জুবেরি ভবনের বিস্তীর্ণ মাঠ। সেই মাঠ পেরিয়ে কয়েক মিনিট হেঁটে ওপারে গেলেই স্বনামে খ্যাত প্যারিস রোড, যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও কোনো বাঁক নেই বা এতটুকু আঁকাবাঁকা, একদম সোজা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। যার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আপনাকে অভিবাদন জানাবে বিশাল বিশাল রেইন ট্রি, কেওড়া, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু আর পাতাবাহারের সারি। রাস্তার প্রতিটি সংযোগ সড়ক যা অন্যান্য ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত ৯০ ডিগ্রি কোণে দুই পাশে দুটি কালভার্ট বা ছোট্ট ব্রিজ বসার জন্য।
প্রতিটি ভবনের সামনে আর পেছনে সুবিশাল আর সুস্বাদু আমবাগান। প্যারিস রোডের একদম শেষে পৌঁছে ডানে গেলেই এক আধুনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া ভাস্কর্য সাবাস বাংলাদেশ স্বচ্ছ আর বিস্মৃত যার উন্মুক্ত মঞ্চ, ঝকঝকে সিঁড়ি, যেখানে রাত কাটে কতশত দুঃখ আর আনন্দমাখা মুখের হাজারো শিক্ষার্থীর। বিশাল মাঠের চারপাশে দেবদারু গাছের দাঁড়িয়ে থাকা, হয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার আবেগের আড়াল।
এমন বিশাল আর উন্মুক্ত মাঠ আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক। আছে নির্ধারিত আর সব সময়ের ধুলো উড়িয়ে যাওয়া বাসস্ট্যান্ড, আছে অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন, অনিন্দ্যসুন্দর লাইব্রেরি, বোটানিক্যাল গার্ডেন, নীরব আর নিরীহ রেললাইন আর তার পাশের চারুকলা, আছে অদ্ভুত সুন্দর এক পুকুর, যে পুকুর কাটা হয়েছে অবিকল বাংলাদেশের ম্যাপের অনুসরণে। ভীষণ আকর্ষণীয় একটা জায়গা সেটা। কিছু দূরে পায়ে অবিকল বা রিকশায় চড়ে পেছনে গেলেই পাবেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বদ্ধভূমি। যেখানে গেলে মন ভালো আর খারাপ দুটোই হবে নিমিষেই।
এ তো গেল রাজশাহী শহর আর তার অনিন্দ্যসুন্দর, সেরা জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া শহরের ভেতরেই একদম সাহেববাজারে প্রাচীন রাজশাহী কলেজের ঠিক উল্টো পাশেই রয়েছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বরেন্দ্র জাদুঘর, যেখানে আছে অনেক পুরাকীর্তি। যা প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার জন্য অনন্য সংরক্ষণ।
রাজশাহী শহরের অদূরেই রয়েছে নাটোরের বিখ্যাত রাজবাড়ি। বনলতা সেন আর তাঁর কবিতা, রয়েছে দেশজোড়া খ্যাতির কাঁচাগোল্লা, পুঠিয়া রাজবাড়ি, আমবাগানের স্বর্গের ছায়া, লিচুবাগানের আমন্ত্রণ। আর একটু দূরে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে প্রাচীন সোনা মসজিদ। যেটার অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। তবে নাটোর বা চাঁপাই যেখানেই যাবেন, দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যাবে অনায়াসে।
আর রাজশাহীর খাবারের মধ্যে দেশ শুধু নয়, উপমহাদেশ জোড়া খ্যাতির নানা রকমের আম, লিচু আর আছে কাঁঠাল। রাজকীয় শহরের রাজকীয় ব্যাপার, মধু মাসের মুধর সমারোহ রাজশাহীর প্রতিটি আনাচে-কানাচে। আর আছে শীতের অন্যতম আকর্ষণ একদম মৌলিক একটা খাবার কালাই রুটি, সঙ্গে বেগুনের ভর্তা আর টক-ঝাল চাটনি। যার স্বাদ এককথায় অমৃত।
সংক্ষেপে এই হলো রাজশাহী। যেখানে পাহাড় নেই, সমুদ্র নেই, চা-বাগান নেই, লেক নেই, অরণ্য নেই, তবে সুখ আছে, শান্তি আছে, আতিথেয়তা আছে, ঐতিহ্য আছে, ফুল-ফলের সমারোহ আছে, আর আছে নিখাদ সরলতা মাখা শত মানুষের সত্যিকারের সমাদর।
তো ঘুরে আসবেন নাকি একবার রাজসিক এই রাজশাহীতে?