ছুটির দিনে
২৫ হাজার টাকায় ভারতের শেষ গ্রাম
তুরতুক বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত ভারতের সীমানার শেষ গ্রাম। এই গ্রামের অবস্থান আমাদের বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার দূরে। শুধু লেহ শহর থেকেই এই গ্রামের দূরত্ব ২০৫ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে ৮-৯ ঘণ্টা! ৩০০০-এর চেয়ে কিছু বেশি লোকের বসবাস আছে এই গ্রামে। এটি বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত গ্রাম। কারণ, এই গ্রামের চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। যেসব পাহাড়ে কোথাও নেই কোনো গাছ, ঘাস বা সবুজের এতটুকু ছোঁয়া। চারপাশের পাহাড়গুলো কোনোটা পাথুরে, কোনোটা মাটির, কোনোটা বরফের, কোনোটা ইস্পাতের মতো কঠোর কিছুর, কিন্তু বিন্দুমাত্র সবুজের ছোঁয়া নেই কোথাও। কিন্তু এই গ্রামের সবটুকু সবুজে মোড়ানো। খুব অদ্ভুতভাবেই। বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদ ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এখানে ধান থেকে শুরু করে গম, জব, আলু-কপিসহ অন্যান্য তরকারি, আপেলসহ নানা রকম ফলমূল হয় নিয়মিত। নানা রকম ফুল, পাথুরে বাড়ি, ঝরনার বিশুদ্ধ পানি সবই আছে এখানে। আছে উত্তাল, খরস্রোতা সায়ক নদী। গায়ে গায়ে লেপটে থাকা পাহাড়ের সারি, পাহাড় থেকে বয়ে চলা ঝরনা, ঝিরি ও নদী। এই গ্রামের আর একটি বিশেষ রহমত হলো, এই গ্রামের বাইরের পাহাড়গুলোতে যখন বরফে বরফে মোড়ানো থাকে, তখনো এখানে বরফ পড়লেও সেটা খুব বেশি নয়, যাতে করে জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। বরফ পড়ে ঠিকই, কিন্তু একটু রোদের পরশ পেলেই সেই বরফ দ্রুত গলে গিয়ে পাশের সায়ক নদীতে গিয়ে পতিত হয়। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেই এই তথ্য পেয়েছি।
তুরতুকের সব ঘর-বাড়িই একদম নিখাদ পাথরের তৈরি। শুধু পার্থক্য এই যে, যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো, তারা পাথর সাইজ মতো করে কেটে নিয়ে কিছু সিমেন্টের ব্যবহার করে সাজানো বাড়ি বানাতে পারে। আর যাদের সেই অবস্থা নেই তারা নিজেদের মতো করে পাথর সংগ্রহ করে একটার পর একটা বসিয়ে দেয়, কখনো নদীর কাদার সাহায্যে বা শুধু পাথরের স্তূপ সাজিয়েই বানিয়ে ফেলে বসবাসের জন্য আস্ত ঘর বা বাড়ি।
পুরো গ্রামের জনপদে ঘুরে ঘুরে আর কিছু কথা বলে যেটুকু বোঝা গেল, এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীই যথেষ্ট দরিদ্র ও বঞ্চিত এক জনগোষ্ঠী। প্রকৃতির দান, বিধাতার আশীর্বাদ, টুরিস্টদের যাওয়া-আসা ওদেরকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে। একদম সাদামাটা একটা জীবন ওদের। যদিও দেখলাম আছে বিদ্যুৎ, টিভি, ডিশের সংযোগসহ আর নানা রকম সুযোগ এমনকি আছে মোবাইলও। তবে সবকিছু মিলে ওরা খুবই দরিদ্র আর অবহেলিত একটি প্রায় বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। যেখানে প্রকৃতি ভীষণ উদার, বিধাতা ভীষণ আবেগি আর ওরা সবাই খুব সাধারণ।
তবে এই গ্রামের যারা একটু অবস্থা সম্পন্ন বা যাদের নিজেদের থাকার ঘর ছাড়াও আছে দু-একটি বেশি বা তার চেয়ে বেশি রুম, সেগুলো ওরা টুরিস্টদের জন্য ভাড়া দিয়ে থাকে। যেখানে একদম কোলাহলমুক্ত একটি দিন বা রাত কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে নিশ্চিন্তে। তুরতুকের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে, ওদের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে। তুরতুকে থাকার পাশাপাশি টুরিস্টদের জন্য আছে কিছু খাবার হোটেলও, যেখানে বেশ সহনীয় মূল্যে পাবেন নানা রকম পছন্দের খাবার, আপনার ফরমায়েসের ভিত্তিতে।
তুরতুকে যাওয়া-আসা ও থাকা খাওয়া
তুরতুকে যেতে হলে এই গ্রামের প্রকৃতি, নীরবতা, ব্যতিক্রমী জীবন যাত্রা, একেবারে সাধারণ মানুষের গ্রামীণ জীবনের সান্নিধ্য পেতে হলে আপনাকে বেশ রোমাঞ্চপ্রিয় হতে হবে। কারণ সরাসরি প্লেনে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, পরিবেশগত কারনে। তবুও মোটামুটি কম কষ্টে একটু বেশি খরচে আর একদম কম খরচে কিন্তু দারুণ রোমাঞ্চরভাবে তুরতুকের যাবার উপায় বলে দিচ্ছি।
ঢাকা থেকে প্লেনে যেতে পারেন দিল্লি, ভাড়া পড়বে ১০-১২ হাজার টাকা। দিল্লি থেকে লেহ প্লেনে ভাড়া পরবে ৩৫০০-৬০০০ টাকা, নির্ভর করবে কত আগে আপনি প্লেনের টিকেট কাটবেন সেটার ওপরে।
এ ছাড়া যেতে পারেন ঢাকা থেকে কলকাতা বাসে ১০০০-২০০০ টাকা, কলকাতা থেকে ট্রেনে দিল্লি ১৫০০-৩০০০ টাকা। দিল্লি থেকে শ্রীনগর বা মানালি হয়ে বাসে বা রিজার্ভ জিপে করে লেহ শহরে (গ্রুপ হলে)। দিল্লি থেকে বাই রোডে লেহ যেতে সময় লাগবে অন্তত তিনদিন। দুই জায়গায় রাতে থাকতে হবে, শ্রীনগর বা মানালিতে এক রাত আর লেহ যেতে পথে আর এক রাত। রাতের থাকার খরচ নির্ভর করবে রুচি আর মানসিকতার ওপরে ৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত পাবেন, মানালি বা শ্রীনগর থাকতে। তবে এই রাস্তায় যেতে হলে বেশ কিছু ঝুকির ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে।
যেমন অধিক উচ্চতা জনিত সমস্যা, শ্বাস কষ্ট, নির্ঘুমতা, মাথাব্যাথা, বমি ভাব, ক্ষুধা কমে যাওয়া, বিষণ্ণ লাগা, এমন নানা রকম লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সেজন্য দরকারি ওষুধ পত্র সঙ্গে রাখা জরুরি। তবে হ্যাঁ এই পথে যদি লেহ শহর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারেন, সেটা হবে সারা জিবনের এক অর্জন সবার জন্যই। যেটা শুধু গেলেই বুঝতে পারবেন। পৃথিবী কত ভয়ানক সুন্দর।
লেহ শহরে পৌঁছে একদিন অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে লম্বা জার্নির ধকল সামলে নিতে। এরপর নিতে হবে নুব্রা ভ্যালি হয়ে তুরতুক যাওয়ার বিশেষ অনুমোদন, জনপ্রতি ৪২০ রুপি করে লাগবে অনুমোদন নিতে। সঙ্গে দিতে হবে মূল পাসপোর্ট। এরপর গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে নুব্রা ভ্যালি হয়ে তুরতুক ২০৫ কিলোমিটার, সময় লাগবে ৮-৯ ঘণ্টা। ভয়ানক, পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যেতে হবে অনেক অনেক, সঙ্গে খরস্রোতা নদী পেরোতে হবে অনেক বার। নুব্রাতে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে অনুমোদন দেখিয়ে নিতে হবে নতুন অনুমোদন সঙ্গে দিতে হবে পাসপোর্টের ফটোকপি, জানাতে হবে কোথায় থাকচেন রাতে, এরপর যেতে পারবেন তুরতুক।
তুরতুকে থাকার খরচ খুব বেশি না, আগের মতোই ৫০০-২০০০ টাকায় থাকতে পারবেন আপনার পছন্দ আর সাধ্য আর রুচি অনুযায়ী, খেতে পারবেন ১৫০-২৫০ টাকায় প্রতি বেলায়।
সবকিছু মিলে বাই রোড আর ট্রেনে করে তুরতুক ঘুরে আসতে খরচ পড়বে ২০ থেকে ২৫ হাজার হাজার টাকা। আর প্লেনে লেহ পর্যন্ত গিয়ে আবার লেহ থেকে প্লেনেই ফিরে আসতে খরচ পড়বে ৪০ হাজার হাজার টাকার মতো জনপ্রতি।