গহিন অরণ্যে
গহিন অরণ্যে তাঁবুতে রাত যাপনের তীব্র ইচ্ছা ছিল। জোছনার আলোয় আলোকিত হবে চারদিক। রাত বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকবে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, বাদুড়ের ঝাঁপাঝাঁপি, শুকনো পাতার মর্মর শব্দ। সৃষ্টি হবে একটি ভৌতিক পরিবেশ। গা ছমছম করে উঠবে। কিন্তু প্রকৃতির সান্নিধ্যে এক ধরনের ভালালাগা কাজ করবে। হারিয়ে যাব ঘুমের রাজ্যে। স্বপ্ন দেখব গহিন অরণ্যের রাজ্যে আমি রাজা।
Rope4 কর্তৃক আয়োজিত অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প 'শেয়ারিং এবং লার্নিং'-এর মাধ্যমে স্বপ্ন হাতের মুঠোয় ধরা দিল। মহিউদ্দীন মাহী ও মারুফা হকের নেতৃত্বে ২২ জনের (বার্সেলোনার কাতালোনিয়া প্রদেশের একজনসহ) গ্রুপের গন্তব্য চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখীল রিজার্ভ ফরেস্ট। ৩ নম্বর সতর্কসংকেত, ভারি বর্ষণ ও রাস্তার জ্যাম সঙ্গে নিয়ে পৌঁছাই নির্দিষ্ট সময়ের তিন ঘণ্টা পরে। প্রশিক্ষক সময়ক্ষেপণ না করে বৃষ্টিতেই কার্যক্রম চালিয়ে গেল। শুরুতেই মিরিঞ্জা, ব্লাইন্ড, ওয়াইল্ড ও রেইন ফরেস্ট নামে চারটি গ্রুপে ২০ জনকে ভাগ করে দিল। ঘোষণা দিল সর্বোচ্চ পারফর্ম করা গ্রুপ ও সেরা ক্যাম্পারের জন্য থাকবে আকর্ষণীয় পুরস্কার।
দলীয় কার্যক্রম চলতে লাগল। লাগাতার বর্ষণে আউটডোর ইভেন্টগুলো স্থগিত (আপাতত) রেখে ইনডোর ইভেন্টে প্রাধান্য দেওয়া হলো। শুরু হলো মেধা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতার সঙ্গে কৌশলের পরীক্ষা। মজাদার কিছু গেমসের এর মাধ্যমে পয়েন্ট ভাগাভাগি হলো। ইনডোরেই পর্বত আরোহণ ও এক্সপেডিশনের মৌলিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো। রোফ, হার্নেস, ক্যারাভিনার, ফিগার-৮, অ্যাঙ্কর, গ্লাভস, আইস এক্স, তাঁবু, ক্রেমপন, স্কার্ফ, হেড লাম্পসহ নানান যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচয় ও রোফ বাঁধার কিছু কৌশল দেখিয়ে দেওয়া হলো। দলীয় নেতাদের হাতে তাঁবু অর্পণ করে স্থাপনের এর দায়িত্ব দেওয়া হলো দলের সদস্যদের।
দিনের শেষভাগে বৃষ্টি কিছুটা কমলে রিভার ক্রসিংয়ের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। লেকের ওপর আড়াআড়ি ৫০ মিটারের চেয়ে বেশি দূরত্বে রোফ বাঁধা হয়। চারপাশে ছিল অসংখ্য জোঁক। এরই মধ্যে হার্নেস পরিয়ে সাইফুল ভাইকে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ক্রসিংয়ের জন্য দেওয়া হয়। শুরুটা ভালো হলেও ফেরার সময় হাঁপিয়ে ওঠে, তবে শেষ পর্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করে। পরে প্রায় সবাই সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়।
রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘুটঘুটে কালচে অন্ধকারের আগমন। আঁধারে ঢেকে গেল চারপাশ। বৃষ্টিও খানিকের জন্য বিদায় নিল। একটি গ্রুপ ক্যাম্প প্রাঙ্গণে আড্ডায় মশগুল আরেকটি গ্রুপ স্থানীয় বাজারে চায়ের কাপে ধোঁয়া তুলল। আলোচনা, অভিজ্ঞতা শেয়ার, নানান পরিকল্পনা আরো কত কী। হঠাৎ বৃষ্টির আগমন লক্ষণীয় হলে ক্যাম্প প্রাঙ্গণের উদ্দেশে ভোঁ-দৌড়।
রাতের খাবার শেষে বসল জলসার আসর। শুরুতে গানের কলি খেলা। মাহী ভাই যেন একটা গানের ভাণ্ডার। তাঁর ভাষ্যমতে, পাঁচ ঘণ্টা অনবরত গান বেরোবে, সে যে শব্দ দিয়েই হোক। প্রতিপক্ষও সমানে সমান। আরো কিছু মজার গেমস ছিল, যার মধ্যে একটি নিরীহ গ্রামবাসী-মাফিয়া নিয়ে। এ খেলাটি ছিল অনেক শিক্ষণীয়। এখান থেকে নিজের আত্মবিশ্বাস, কথা বলার গুরুত্ব, ধারণার প্রতিফলনের ফলাফল ও যা সাধারণত ভেবে থাকি, তার বিপরীত যে ঘটে থাকে তা দেখা যায়।
রাত ১টা। ঘুমের রাজ্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ একটি গ্রুপ তাঁবুতে আরেকটি গ্রুপ অফিস রুমের ফ্লোরেই ঘুমাবে। অতিরিক্ত বর্ষণে কাদায় একাকার অবস্থা দেখে বেশির ভাগই তাঁবুতে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। ২২ জনের মধ্যে মাত্র নয়জন যেতে রাজি হয়, তবে যাওয়ার প্রাক্কালে জঙ্গলে জোক, অজগর, নানান বন্যপ্রাণীসহ চিতা বাঘও আছে বলে জানা যায়। ভয় পেয়েও পিছু না হটে থাকার সাহস করে বৃষ্টিতে ভিজে কাদা মেখে তাঁবুতে রওনা হলাম। একাই এক তাঁবুতে। ভয়ে গা ছমছম করছে। চারদিকে গহিন জঙ্গল। অদ্ভুত সব শব্দ। সঙ্গে আছে ঝুমবৃষ্টি। ভয় ঝেড়ে ফেলে লাইট বন্ধ করে সবকিছু উপভোগ করতে লাগলাম। তাঁবুর ওপর শিল পড়ার মতো বৃষ্টির ফোঁটা আর নিচ দিয়েও পানির গড়াগড়ি। সব মিলে ছিল জীবনের সেরা একটি উপভোগ্য রাত।
পিচঢালা রাস্তা ধরে চা বাগানের পাশ দিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে দ্বিতীয় দিনের পথচলা শুরু। কিছুদূর এগোলেই ডান পাশ হয়ে চলে গেছে ঝর্ণার ট্রেইল। সামনে কয়েকটি পাহাড় পাড়ি দিয়ে উঁচু একটি স্থানে এসে সমবেত হলাম। চারদিকের দৃশ্য ছবির মতো লাগছিল। প্রকৃতির অপরূপ মায়াজালে বিদ্ধ প্রায়। নিজেকে সঁপে দিতে মন চায়। নগরবাউলের গান মনে পড়ে যায়—
ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে
হারিয়ে যাই লালন বেশে,
ছিনিয়ে নিয়ে একতারাটা
বাজাই সুখে!
প্রশিক্ষকের ডাকে সংবিত ফিরে আসে। এরই মধ্যে ক্লাইম্বিং ও জুমারিংয়ের জন্য সেট তৈরি করা হয়েছে। সার্বিক সহযোগিতায় আছেন নীরব, ফরহাদ জিয়ন ও শান। এবার হৃষ্টপুষ্ট আতিক ভাইকে দিয়ে প্রায় ১০০ মিটার পাহাড় বেয়ে ক্লাইম্বিং ও জুমারিং শুরু। সফলভাবে শেষ করে তবে সময়সাপেক্ষ হয়। একে একে তাইতি, সাদিয়া, অন্তরা, শাহানা আপু, ড্যানিয়েল, ফাহিম ভাই, নাহিদ, আফিফ ও শামিম ভাইসহ সকলে ভালোভাবে সম্পন্ন করে।
এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে ট্রেইলে জলকেলিতে মাতোয়ারা হয়ে লাফঝাঁপ, ফটোশেসন ও দলগত খেলা ঘোড়দৌড় চলে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় সেরা ক্যাম্পার মশিউর ও পারফরমার দল ওয়াইল্ডের নাম। এ ছাড়া বাকি সবার জন্য ছিল সান্ত্বনা পুরস্কার ক্যাম্প ব্যাজ। আগামীর পর্বত আরোহণে এ শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় ও অঙ্গীকার এবং যেকোনো স্কুলে কিংবা যারাই ডাকবে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে শেষ হয় অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প 'শেয়ারিং এবং লার্নিং'। এগিকে যাক Rope4।