অল্প সময়ে, স্বল্প খরচে বাংলার আমাজনে
যাঁরা সুন্দরবনে গেছেন, তাঁরা দেখলে বলবেন আরেকটা সুন্দরবন। তবে এটা আসল সুন্দরবন থেকে বেশ নিরাপদ আর সহজে যাতায়াত করা যায়। এটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের কাছে সিলেটের সুন্দরবন নামেই পরিচিত। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত প্রকৃতির রূপে রঙিন 'জলারবন' রাতারগুল। অল্প সময়, কম খরচে হাতের নাগালে এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে আসতে পারলে আপনি মুগ্ধই হবেন। রাতারগুলের অনিন্দ্যসুন্দর জলকেলি, গড়পড়তা ১০ ফুট নীল স্বচ্ছ পানিতে ডুবন্ত গাছপালার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার সৌন্দর্য যে কাউকে মোহিত করবে।
প্রকৃতির রূপে রঙিন রাতারগুল। মিঠাপানির জলাবনটিতে উদ্ভিদের দুটো স্তর রয়েছে। ওপরের স্তর মূলত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত। যেখানে নিচের স্তরটিতে ঘন পাটিপাতার (মুর্তা) আধিক্য বিদ্যমান। বনের উদ্ভিদের চাঁদোয়া সর্বোচ্চ ১৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ছাড়া অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত। এখন পর্যন্ত এখানে সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। জলমগ্ন এ বনে আরো রয়েছে হিজল, তমাল, করচ আর বরুণ গাছ, পিঠালি, অর্জুন, ছাতিয়ান, গুটিজাম, জালিবেত, জারুলম আর আছে বটগাছ।
জলমগ্ন এ বনে রয়েছে বানর, নানা প্রজাতির অজগর, দাঁড়াশ, গোখরা, গুইসাপসহ বেশ কয়েক জাতের বিষধর সাপ, বিচ্ছু, মেছোবাঘ, বুনো শূকর, কাঠবিড়ালি, বেজি, ভোঁদড়, বনবিড়ালসহ জল ও স্থলের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, ঘুঘু, চড়ুই, পানকৌড়ি, চিল, বালিহাঁস, বকসহ নানা প্রজাতির পাখি ও উদ্ভিদ। ভাগ্য ভালো থাকলে আপনার সামনে পড়তে পারে এসব প্রাণীর যে কেউ। তবে সাপের দেখা মিলবে সহজে। ভয়ও পেতে পারেন। খুব কাছ থেকে গাছের ওপর অলস বসে থাকা সাপের দেখা কেবল এ বনে মেলে। বেশ রোমাঞ্চকর বিষয়। তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। মূলত বর্ষার সময় এ বনের আসল সৌন্দর্য দেখা মেললেও শীতকালে রাতারগুলে আসে বালিহাঁসসহ প্রচুর পরিযায়ী পাখি, আসে বিশালকায় শকুনও। মাছের মধ্যে আছে টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউশ, রুইসহ বিভিন্ন জাত।
স্বচ্ছ নীলচে পানির ওপরে ভাসমান বন রাতারগুল। এ জলবন প্রকৃতির আরেক নিদর্শন। ভ্রমণপিপাসুদের প্রাণে দোলা দেয় রাতারগুলের সবুজ অরণ্যের নীলজল। জলে নিম্নাঙ্গ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের গাছগুলো দেখতে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভিড় করেন পর্যটক। বনের ভেতর ভ্রমণ করতে দরকার হয় নৌকার, তবে সেগুলো হতে হয় ডিঙি নৌকা। ডিঙিতে চড়ে বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির রূপসুধা। জলাভূমির বনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বর্ষাকালে এই বন পানিতে ভরে যায়। এই বনের গাছগুলো পানিতে মারা যায় না; বরং পানিতে আরো সবুজ হয়ে ওঠে। এ ধরনের বনে ঢুকলেই আপনার মনে হবে গাছগুলোর শিকড় বোধ হয় পানিতেই জন্মেছে। প্রায় ১০-৩০ ফুট পানিতে ডুবে থাকে গাছগুলো। তাই এ ধরনের বন অন্যসব বন থেকে আলাদা। অল্প সময়ের মধ্যেই মিশে যাবেন রাতারগুলের অপার সৌন্দর্যের সঙ্গে। চারপাশের নীরবতা বিমোহিত করবে। নাম-না-জানা পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দই কানে আসবে না। অদ্ভুত সেই অনুভূতি। ধীরে চলা নৌকা, মাঝির সঙ্গে একটানা আলাপন চললেও আপনার চোখ ধাঁধাবে এর বাইরের প্রকৃতিও। নৌকা থেকে ভেসে ওঠে গ্রামের বাড়িঘর, হাওর, সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। স্বচ্ছ পানিতে নিজের প্রতিচ্ছায়া। ছোট খেয়া নৌকা নিয়ে এ জলবনে এর বাইরে খুব বেশি কিছু দেখার মেলে না বটে, তবে যতক্ষণ সময় কাটাতে পারেন প্রকৃতি আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য ভুবনে।
যাঁরা দেশে থেকেই আমাজন জঙ্গলের স্বাদ নিতে চান, তাঁরা বর্ষার পানি থাকতে এখনই বেরিয়ে পড়ুন। নিশ্চিত করে বলা যায়, আপনাদের পয়সা পুরোমাত্রায় উসুল হয়ে যাবে। এখানে এসে যাত্রীবেশে মাঝির কাছ থেকে সিলেটের সুন্দরবন রাতারগুল সম্পর্কে অনেক টুকটাক তথ্যও জেনে নিতে পারেন।
যাতায়াত
সিলেট শহরকে ঠিক পেছনে ফেলে বিমানবন্দরের রাস্তা ধরে সালুটিকর হয়ে সিএনজিযোগে যেতে হবে রাতারগুলের মোটরঘাটের দিকে। এর পর সিএনজি থেকে নেমে প্রথমে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটেই তবে আপনি ঘাটে পৌঁছাতে পারবেন। শহরের আম্বরখানা এলাকা থেকে মিলবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ঘাটে গিয়ে ৬০০-৮০০ টাকায় ভাড়া পবেন ডিঙি নৌকা। দরদাম করে নিতে হবে। যাওয়ার পথে সিএনজি ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা। চাইলে রিজার্ভ কিংবা লোকল সার্ভিসে যেতে পারেন। একই পথ ধরে ফিরতে হবে আপনাকে সিলেট শহরে।
থাকা-খাওয়া
সিলেট শহর থেকে বেশ দূরে না হওয়ায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা শহরে হলেই ভালো। রাতারগুলের একেবারে আশপাশে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে সিলেট শহরে আপনি চাইলে ছোট-বড় যেকোনো হোটেল-মোটেল পাবেন সহজেই। রাতাগুল ঘুরতে যাওয়া-আসাসহ মোট পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় লাগবে।
সতর্কতা
যাঁরা সাঁতার জানেন না, রাতারগুল ভ্রমণ তাঁদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এখানে ব্যবহৃত নৌকাগুলো একটু ছোট হওয়ায় দুলতে থাকে সব সময়। সচেতনভাবে নৌকায় চড়তে হবে। আর সাপ-বিচ্ছু থেকে বেঁচে থাকতে বিশেষ নজর রাখতে হবে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ভ্রমণে নিতে হবে আলাদা সতর্কতা। এখানের ওয়াচ টাওয়াটিও নির্মাণে ত্রুটি থাকায় সেখানেও বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। সম্ভব হলে ওয়াচ টাওয়ার ব্যবহার না করাই ভালো। মাঝেমধ্যে সরকারি নির্দেশনাও আসে একসঙ্গে অনেকে এটি না ব্যবহার করার জন্য। এ ছাড়া রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সঙ্গে ছাতা নিয়েও যেতে পারেন।