ছুটির দিনে
‘পাথারিয়া’ অভিযান ও পুছুমের খেলা
মৌলভীবাজার জেলার উত্তর প্রান্তিক জনপদ বড়লেখা উপজেলা। অনিন্দ্যসুন্দর নিসর্গের এক মায়াবী এ উপজেলা। পূর্বে ভারতের প্রায় ২০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত। দক্ষিণে জুড়ী ও কুলাউড়া। পশ্চিমে রয়েছে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা। শুধু নামে নয়, বড়লেখা গুণেও বড়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত ও এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি এ উপজেলায়। আতরের জন্য প্রসিদ্ধ এ উপজেলার সুজানগর ইউনিয়ন। আছে দুটি বিশেষ আদিবাসী সম্প্রদায় খাসিয়া ও মণিপুরী। সুন্দর মণিপুরী নৃত্য অসাধারণ-অনন্য। এই উপজেলায় আছে পাথারিয়া পাহাড়। একসঙ্গে অরণ্য দেখা আর পাথুরে ঝর্ণার পানিতে শরীর ভেজাতে চাইলে এর চেয়ে আদর্শ স্থান বেশ কমই আছে।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ৮ নম্বর দক্ষিণ ভাগ ইউনিয়নের গৌড়নগর মৌজার অর্ন্তগত এ পাহাড়ে ঘেরা গহিন অরণ্যের নাম ‘পাথারিয়া’। মূলত এখানে পাথরী নামক জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের নামকরণে এর নাম হয়েছে ‘পাথারিয়া’। এই পাহাড়টি প্রায় ২৪ কিলোমিটার বিস্তৃত, যার অন্য অংশ ভারতের আসাম রাজ্যের ভেতর। পাথারিয়া পাহাড়ের চারদিকে সবুজের পরিবেশ। ওপরে নীল আকাশ, নিচে থরে থরে সাজানো আকাশচুম্বী পাথারিয়া পাহাড়। বিশাল পাহাড় মাথা উঁচু করে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিধাতা যেন পাহাড়টি তুলির অপূর্ব আঁচড়ে অপরূপ রূপে সাজিয়েছেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম বড়লেখার উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২৫ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ের জন্ম অনেক আগে, অর্থাৎ বেশ অনেক আগেই তৈরি এ অঞ্চল। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ, যথা—দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা ইত্যাদি। এগুলোর উচ্চতা প্রায় ২৪৪ মিটার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত মাধবকুণ্ডের অবস্থান এর ঠিক পাশেই। অনেকে মাধবকুণ্ডের নাম শুনে থাকলেও ‘পাথারিয়া’ নিয়ে কারো তেমন আগ্রহ দেখা যায় না।
এখানে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ঝর্ণা রয়েছে। স্থানীয় খাসিয়াদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত ঝর্ণাটির নাম হলো ‘পুছুম’। পুছুমের ঝিরি পথটি খুব স্বচ্ছ পানির। অরণ্যে ঘেরা নিবিড় ছায়ার শব্দহীন রাজ্য। তবে পাখপাখালির আনাগোনা আছে। আছে বন্য প্রাণী। পাথুরে এ পথ ধরে এগোলেই পাওয়া যায় পুছুমের দেখা। তবে সর্বসাধারণের এটা খুঁজে বের করা দুষ্কর। এ পথে হাঁটতে গাইড ছাড়া চলা মুশকিল। ‘পুছুম’ পাথারিয়া পাহাড়ের অন্যতম বড় একটি ঝর্ণা। ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে হয় এক ঘণ্টার মতো।
মজার ব্যাপার হলো, স্থানীয়দের ভাষায় ‘পুছুম’ শব্দের অর্থ হলো ঝর্ণা, তাই এটাকে ঝর্ণার ঝর্ণাই বলা যায়। পাথারিয়া পাহাড়ে আরো বেশ কয়েকটি ঝর্ণা আছে। তাদের মধ্যে ‘বান্দরডুভা’ একটি। পুছুম থেকে বান্দরডুভা আসতে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগে। বান্দরডুবা ঝর্ণাটির পথ একটু বিপদ সংকুল। এক অর্থে অ্যাডভেঞ্চার যাকে বলে। পাহাড়ি পথ ও পাহাড় বেয়ে তার পরই ‘বান্দরডুভা’ দেখা মেলে। এটি প্রায় ১০০/১২০ ফুট উঁচু একটি ঝর্ণা। কিন্তু এর সামনে একটি পাথরের আবরণের কারণে এর আকার ঠিক বোঝা যায় না। ‘পাইথুং’ আরো একটি ঝর্ণা। যারও দেখা মিলবে পাথারিয়া পাহাড়ে। বান্দরডুবা থেকে এর দূরত্ব ২০ মিনিট। এটি পাথারিয়া পাহাড়ে একমাত্র ডাবল ফলস, যার দুই দিক দিয়ে পানি পড়ে। কিন্তু এটি আকারে বেশ ছোট। ‘রজনীকুণ্ড’ দেখার মতো আরো একটি ঝর্ণা। ১ দশমিক ৫ ঘণ্টার এক্সট্রিম ঝিরিপথ। অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এ ঝর্ণার রাস্তা। এটি সবচেয়ে কঠিন ঝিরিপথ।
পাথারিয়া পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, পাথারিয়া পাহাড়ে রয়েছে বড় বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজস্র জাতের লতা, ঢাউস পাতার বুনো রামকলার ঝোঁপ। ফুলের মধ্যে আছে আশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাঁপা, পারুল, জংলি জুঁই, নাগবাল্লী, লুটকি, নীললতা, টালি, ল্যডিস আম্ব্রেলা, ডুলিচাঁপা, ম্যাগনোলিয়া এবং আরো নানা জাতের ফুল। ফল-ফসলের মধ্যে আছে বিভিন্ন রকমের শাক, কচু, লতি, বাঁশের খোড়ল (করিল), লেবু, রামকলা, ডেউয়া, লুকলুকি, ক্ষুদিজাম, চালতা, জাম, বহেড়া, হরীতকী, বুনো আম, কাঁঠাল, আমলকী, গোলাপজাম, সাতকরা লেবু, তৈকর, আশফল, গুঙ্গাআলু এবং আরো নানা জাতের পাহাড়ি ফলমূল। এই পাহাড়ে রয়েছে বিচিত্র রকমের বন্য প্রাণী, জংলি হাতি, বানর, হনুমান, বাগডাস, মেছোবাঘ, বনরুই, হরিণ, খরগোশ, অজগর সাপ প্রভৃতি। পাখপাখালির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় বনমোরগ, শকুন, ঈগল, তিতির, শ্যামা, ভিমরাজ ও আরো বিভিন্ন জাতের পাখি।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোনো প্রান্ত থেকে ট্রেনে এলে নেমে যেতে পারেন কুলাউড়া স্টেশনে। সেখান থেকে ৪০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে দক্ষিণভাগ। দক্ষিণভাগ থেকে সিএনজিতে সমনভাগ হাসপাতালের সামনে। তার পর গাইড নিয়ে হাঁটাপথে পাথারিয়া ভ্রমণ।
সরাসরি বড়লেখা বাজারে আসতে পারেন। সার্ভিস রয়েছে এনা ও শ্যামলী পরিবহনের। বড়লেখা থেকে ২০০ টাকার মতো ভাড়ায় সিএনজি রিজার্ভ করে যাওয়া যায় সমনভাগ হাসপাতালের সামনে। এরপর যথারীতি গাইড নিয়ে হাঁটা শুরু।