ছুটির দিনে
টাঙ্গুয়ার হাওর ও যাদুকাটা নদীর মুগ্ধতা
প্রকৃতির নির্মল রসায়নের এক অপরূপ আনন্দধারার দেখা পাবেন সুনামগঞ্জের পাহাড়, নদী আর হাওরের বাঁকে বাঁকে। সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতির একটি অনবদ্য উপন্যাসের শতসহস্র ছন্দের উপকথার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন; টেকেরঘাট, নীলাদ্রি, যাদুকাটা নদী আর বারেকের টিলার প্রকৃতির রূপ ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
কখনো অভিলাষী হাওরের গন্তব্যহীন যাত্রা, কখনো বা নিভৃত জলরাশির অভিমানী কান্নার মুখশ্রীর প্রতিমূর্তি দেখতে পাবেন নীলাদ্রির শরীর ছুঁয়ে। পাহাড়ি মাদকতা আর ঝর্ণাধারার স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে পারবেন টেকেরঘাটের সমগ্র শরীরে। যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ পানির সঙ্গে লাল বালু আর পাহাড়ের অমিত প্রেমের মুগ্ধতা উপভোগ করতে পারবেন বারেকের টিলা থেকে।
কখন যাবেন
অবশ্যই বর্ষাকালে এবং জোছনা রাতে। এ ছাড়া অতিথি পাখি দেখতে চাইলে শীতকাল উপযুক্ত সময়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী আর মামুন এন্টারপ্রাইজের বাস সকাল থেকেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত সুনামগঞ্জ সদরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এ ছাড়া উত্তরা থেকে রওনা হলে এনা পরিবহনের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ আসতে পারেন। রাতের সাড়ে ১১টার বাসে যাত্রা শুরু করলে ভোর ৫টা-৬টার মধ্যেই আপনি সুনামগঞ্জ পৌঁছে যাবেন। অতিরিক্ত ক্লান্তি থাকলে চার/পাঁচ ঘণ্টার জন্য আশপাশের কোনো হোটেলে আলোচনার মাধ্যমে বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন। মনে রাখবেন, সুনামগঞ্জে ভালো হোটেলের সংখ্যা খুবই কম। অথবা আপনি চাইলে বাস থেকে নেমে, পুরান বাসস্ট্যান্ড থেকে সকালের নাশতা সেরে সরাসরি টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন। ট্যুর প্ল্যান আপনার অবস্থান আর সাময়িক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার জন্য সুরমা ব্রিজ পাড়ি দিয়ে লেগুনা/বাইকে করে তাহিরপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। ট্যুর মেম্বার বেশি হলে লেগুনা দিয়ে গেলে খরচ কম পড়বে। সুরমা নদীর ওপার থেকে লেগুনা দিয়ে তাহিরপুর যেতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লেগে যাবে। তাহিরপুর পৌঁছানোর পর তাহিরপুর বাজারঘাট থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা অথবা ট্রলারে পরের দিন সকাল পর্যন্ত ভাড়া করুন। বড় নৌকাগুলো ভাড়া করলে রাতে ঘুমানো এবং টয়লেটের বিষয়ে একটু বেশি সুবিধা পাবেন। চাইলে মাঝিদের সঙ্গে আলাপ করে দুপুর/রাতের খাবার নৌকায় রান্না করার ব্যবস্থা করে নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনাকে তাহিরপুর বাজার থেকেই বাজার করে নিতে হবে।
তবে মাঝিদের রান্না করা খাবারের মান সুবিধাজনক না হওয়ার গুঞ্জন থাকায় এ ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো। কেননা, আপনি দুপুরের খাবার তাহিরপুর বাজার থেকে খেয়ে উঠলে অথবা সকালে একটু ভালো নাশতা করে উঠলে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওরে ঘোরার পর রাতের খাবার অনায়াসেই টেকেরঘাট বাজারে খেতে পারবেন। কেননা, রাতে আপনাকে টেকেরঘাটেই থাকতে হবে। সুতরাং খাবার নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।
টয়লেটের বিষয়ে নৌকায় যে সুবিধা রয়েছে, তাতে করে কিছুটা কষ্ট হলেও আরামসে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন।
সুতরাং টয়লেট আর খাবারের বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মনভরে টাঙ্গুয়া হাওর ঘুরে দেখুন। যদি পারেন প্রথম দিন সন্ধ্যায় অথবা পরের দিন সকালে টেকেরঘাটে অবস্থিত লাখমাছড়া ঝর্ণা ঘুরে আসুন।
সারা রাত জোছনাবিলাস করার পর পরের দিন সকালে নৌকা ছেড়ে দিন আর সকালের নাশতা টেকেরঘাটেই সেরে নিন। তারপর বারেকের টিলা আর যাদুকাটা নদীর উদ্দেশে রওনা দিন। বারেক টিলা আর যাদুকাটা নদী একই জায়গায় অবস্থিত। সকাল ৮টায় রওনা দিলে ৯টার মধ্যেই বারেক টিলায় পৌঁছে যাবেন। বারেক টিলা আর যাদুকাটা নদী আপনি তিন/চার ঘণ্টার মধ্যেই ঘুরে শেষ করতে পারবেন। সুতরাং ঢাকা ফেরার তাড়া থাকলে দুপুর আড়াইটায় বাসের টিকেট কেটে রাখতে পারেন। অথবা সারা বিকেল আরামে ঘুরে রাত ১০টার বাসে ঢাকা ফিরতে পারেন। বিষয়টা সম্পূর্ণ আপনার ওপর নির্ভর করে। উল্লেখ্য, দুপুর আড়াইটা ও রাত সাড়ে ৯টা—এ সময়ের মাঝে আর কোনো বাস ঢাকার উদ্দেশে সুনামগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসে না।
বারেক টিলা ঘোরার পর আপনাকে নৌকাযোগে যাদুকাটা নদী পাড়ি দিতে হবে। যাদুকাটা নদী পাড়ি দেওয়ার পর লাউরের ঘর বাজার থেকে বাইকযোগে আপনাকে সুনামগঞ্জ সদরের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। সুনামগঞ্জ সদরে যেতে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে (২৬ কিলোমিটার প্রায়)। হাতে সময় থাকলে হাসন রাজা মিউজিয়ামটা ঘুরে আসুন, বেশি সময় লাগবে না। সদর থেকে ৫০/৭০ টাকা ভাড়ায় অটোতে করে চলে যান।
হাসন রাজা মিউজিয়াম দেখা শেষ হলে সেখান থেকে হেঁটেই পুরোনো বাসস্ট্যান্ড চলে আসুন। সেখান থেকেই প্রিয় শহর ঢাকার উদ্দেশে রওনা শুরু করে দিন।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য সুনামগঞ্জ পুরোনো বাসস্ট্যান্ডে বেশ কিছু আবাসিক হোটেলের দেখা মিলবে। নিজের চাহিদামতো বাছাই করে নিন। উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জে মানসম্মত হোটেলের সংখ্যা কম। যদি নৌকায় রাত পাড়ি দেন, সে ক্ষেত্রে হোটেলের প্রয়োজন পড়বে না।
কোথায় খাবেন
সুনামগঞ্জ সদরের রোজ গার্ডেন রেস্টুরেন্টটি বেশ ভালো। এ ছাড়া তাহিরপুর বাজারেও বেশ কিছু খাবারের হোটেল রয়েছে। নৌকায় খাবারের আয়োজন না করলে অনায়াসে স্বল্প খরচে টেকেরঘাট বাজারেই রাত/দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারবেন। বারেকের টিলায় খাবারের মূল্য কিছুটা বেশি, তবে দু/তিনটি মধ্যমানের খাবারের হোটেলের দেখা পাবেন।
কোথায় ঘুরবেন
টাঙ্গুয়ার হাওরে মন উজাড় করে ঘুরুন, অসাধারণ ভালোলাগা কাজ করবে। টাঙ্গুয়ার হাওরে অবস্থিত ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো হাওর এলাকা দেখার চেষ্টা করুন। এ ছাড়া ওয়াচ টাওয়ারের নিচে স্বচ্ছ পানিতে গোসল করতে পারেন। নীলাদ্রির নয়নাভিরাম দৃশ্যে নিশ্চিত আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। রাতের বেলায় নৌকায় শুয়ে শুয়ে হাওরে জোছনা উপভোগ করুন। বিশ্বাস করুন, সমস্ত দুঃখ নিশ্চিত শুভ্রতায় পরিণত হবে। রাতে থাকাটা যথেষ্ট নিরাপদ, সুতরাং ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
লাখমাছড়া ঝর্ণার রূপ উপভোগ করুন, এ ছাড়া টেকেরঘাটেই অবস্থিত চুনাপাথরের খনিটাও ঘুরে দেখতে পারেন। বারেকের টিলা থেকে যাদুকাটা নদী আর ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়গুলোর রূপ উপভোগ করুন। এখান থেকে যাদুকাটা নদীর অপর প্রান্তের লাল বালুর বিস্তীর্ণ এলাকার সঙ্গে নদী আর পাহাড়ের মিলে থাকার রসায়ন দেখলে কী যে ভালো লাগবে, চিন্তাও করতে পারবেন না। অদ্ভুত সুন্দর!! অবশ্যই যাদুকাটা নদীতে গোসল করতে ভুলবেন না।
যাদুকাটা নদী পাড়ি দেওয়ার সময় পুনরায় লাল বালুর বিস্তীর্ণ এলাকার সঙ্গে নদী আর পাহাড়ের মিলে থাকার রসায়ন দেখতে পাবেন।
বারেকের টিলা আর যাদুকাটা নদী থেকে দুই রকমের রূপ দর্শন করতে পারবেন। দুটি দৃশ্যের প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা।
যে বিষয়ে বিরত থাকবেন :
১. হাওরে, পাহাড়ে অথবা নদীতে কোনোক্রমেই চিপস, সিগারেট, বিস্কিটের প্যকেট অথবা অন্য যেকোনো ধরনের ময়লা ফেলবেন না।
২. ময়লা রাখার জন্য নিজেদের কাছে একটি পলিব্যাগ রাখুন, পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট কোনো ডাস্টবিনে ময়লা ফেলুন।
৩. অনেকেই সেখানে নেশা করে এবং সেই বোতলগুলো পানিতে নিক্ষেপ করে। বিষয়টা প্রচণ্ড দুঃখজনক। দয়া করে এ ধরনের জঘন্য অপকর্ম হতে নিজে বিরত থাকবেন এবং অন্যকেও সচেতন করার চেষ্টা করবেন।
সীমান্তের পাশ দিয়ে সাবধানে চলাচল করবেন, ভারত সীমান্ত থেকে একটু দূরে থেকে চলাচল করার চেষ্টা করুন।
৪. তাহিরপুর, টেকেরঘাট ও বারেকের টিলার মানুষগুলো যথেষ্ট সহজ-সরল, এঁদের সঙ্গে দয়া করে ছলচাতুরী করবেন না।
খরচ কেমন পড়বে
ঢাকা-সুনামগঞ্জ (নন-এসি ৫৫০ টাকা, এসি-৮০০ টাকা); পুরান বাসস্ট্যান্ড থেকে সুরমা ব্রিজ পাড়ি দিন (১০ টাকা/ প্রতিজন); সেখান থেকে ১০০ টাকা প্রতিজনে লেগুনা ভাড়া করে তাহিরপুর; তাহিরপুর থেকে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে মাঝারি অথবা বড় আকারের ইঞ্জিনচালিত নৌকা অথবা ট্রলার ভাড়া করে নিন পরের দিন সকাল পর্যন্ত; টেকেরঘাট থেকে বারেকের টিলায় বাইকে ৭৫ টাকা প্রতিজন; বারেকের টিলা থেকে পাঁচ টাকার বিনিময়ে যাদুকাটা নদী পাড়ি দিয়ে লাউড়ের ঘুরে আসুন; সেখান থেকে বাইকে ১২৫ টাকা প্রতিজনে সুরমা ব্রিজের প্রান্তে চলে আসুন; এর পর হাসন রাজা মিউজিয়াম এ যেতে ৫০/৭০ টাকায় লেগুনা ভাড়া করে নিন; ১০ টাকার বিনিময়ে হাসন রাজা জাদুঘর ঘুরে দেখার পর হেঁটে বাসস্ট্যান্ড চলে আসুন। খাবার খরচ ৪৫০ টাকা প্রতিজন/প্রতিদিন।
প্রয়োজনীয় ফোন নম্বরগুলো
ট্রলার এবং বারেকের টিলা যেতে বাইকের জন্য মুহাদ্দিস (বেশ ভালো মাঝি)-০১৭১৫৯৬০১০২
বারেকের টিলায় থাকা-খাওয়া অথবা যেকোনো ধরনের সহযোগিতার জন্য-০১৯১৮৭৭০০৪৮(আশিক)
লাউড়ের ঘর থেকে সুনামগঞ্জ সদর আসার বাইকের জন্য-০১৭২১৯৫৪২২ ( নজরুল)
হাসন রাজা মিউজিয়াম-০১৭৪৯৭১১৭৭৫
উপজেলা ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার কৃপেশ দাস : ০১৭২৪৯৬৮১৬১
উপজেলা গেস্টহাউসের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান আনিসুল হককে অনুরোধ করতে হবে : ০১৭১৫১৭২২৩৮
ইট-কাঠের এই বেড়াজাল আর নাগরিক কোলাহলের পরিশ্রান্ত জীবনের ক্লান্তিবোধ দূর করতে এবং প্রকৃতির স্পর্শ পেতে আপনি নয়নাভিরাম দৃশ্যে দেখতে চান। তাই এই নাগরিক ব্যস্ততা থেকে কিছুটা সময়ের জন্য ছুটি নিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে খানিকটা সময় কাটিয়ে আসুন।
তারপর না হয় পূর্ণ সজীবতা নিয়ে পুনরায় শহুরে কোলাহলে ঝাঁপিয়ে পড়ুন । একটি সুন্দর , স্বচ্ছ আর নির্মল মানসিকতার জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্য আপনাকে মুঠো ভরে অনেক কিছুই দিয়ে যাবে, বিনিময়ে কিছুই চাইবে না।