নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি খেয়েছেন তো!
টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও জামালপুর নামগুলোর আদ্যাক্ষর পরপর সাজালে দাঁড়ায়—টা নে কি ম জা। এগুলো নিয়েই ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর জেলা ময়মনসিংহ। ইংরেজিতে ময়মনসিংহকেও আবার ভেঙে ভেঙে অনুবাদ করার একটি রম্য রয়েছে। আমার-My, Men-মানুষরা, Sing-গান করে + h = Mymensingh। এই ময়মনসিংহের আসলে একটি বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। সেখানে বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রতিটি জেলার আলাদা ইতিহাস ও ঐতিহ্যে একেবারেই স্বতন্ত্র, তেমনি একটি জেলা হলো নেত্রকোনা।
সারা দেশের মতো নেত্রকোনায়ও অনেক প্রসিদ্ধ জিনিস এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। সে রকম একটি ঐতিহ্য হলো সেখানকার শতাধিক বছরের পুরোনো নেত্রকোনার নামকরা ও বিখ্যাত ‘বালিশ মিষ্টি’। এটি স্বাদ, গন্ধ, রং ও আকার-আকৃতিতে অনন্যসাধারণ। একবার মুখে নিলে এর স্বাদ ও গন্ধ মুখে লেগে থাকে, যা সারা জীবন মনে রাখার মতো। ‘গয়ানাথ’ নামক এক কারিগর শতাধিক বছর আগে থেকে এ বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। সে জন্য একে লোকে গয়ানাথের মিষ্টি ও গয়ানাথের চমচমও বলে থাকে। বালিশ মিষ্টি আকারভেদে একেকটির ওজন প্রায় দুই কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। খাদক না হলে একটি মিষ্টি কখনো একজনে খেয়ে শেষ করতে পারবে না। তবে আগে থেকে অর্ডার দিলে সেটিকে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ছোট-বড় করে তৈরি করে দিতে পারে। মিষ্টি দেখতে মানুষের শোয়ার বালিশের (পিলো) আকার ও আকৃতির হয় বিধায়ই একে বালিশ মিষ্টি বলা হয়। এসব এলাকার একটি রীতি আছে এ রকম যে, সেখানে কোনো বিয়েতে বর তাঁর নতুন শ্বশুরবাড়িতে বালিশ মিষ্টি না নিয়ে গেলে সেখানকার রীতিসিদ্ধ হয় না। বালিশ মিষ্টির দামও খুব বেশি নয়, একেবারে নাগালের মধ্যেই।
সাধারণ যেকোনো মিষ্টির প্রায় সমান দামেই বিক্রি হয় এটি। এলাকার কোনো লোক কোথাও দূর-দূরান্তে কিংবা অন্য জেলায় বেড়াতে গেলে এ মিষ্টির জুড়ি নেই। এ মিষ্টি এখন নেত্রকোনায় একটি নির্দিষ্ট গয়ানাথের দোকান ছাড়াও সেখানকার অনেক দোকানেই কিনতে পাওয়া যায়। কারণ, দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৬৯ সালে গয়ানাথ যখন দেশত্যাগ করেন, তখন তাঁর বংশধরদের গোপন রেসিপি ও বানানোর ফর্মুলা শিখিয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকে গয়ানাথের ভাবশিষ্য ও কর্মচারী নিখিল মোদক ওস্তাদের ফর্মুলায় এটি সেই আদি ও অকৃত্রিমভাবে তার গুণগতমান ঠিক রেখে বানিয়ে চলেছেন। স্বভাতই পাঠকের মনেও প্রশ্ন জাগতে পারে, নেত্রকোনা কোথায়? কীভাবেই বা যাওয়া যায় সেখানে?
নেত্রকোনা জেলাটি ১৯৮৪ সালে সাবেক ময়মনসিংহ জেলার মহকুমা থেকে আলাদা জেলা হয়েছে। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং রাজধানী ঢাকা শহর থেকে মাত্র প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরত্ব নেত্রকোনার। এখন আগের তুলনায় রাস্তা অনেক ভালো হওয়ায় সড়কপথে মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই ঢাকা থেকে নেত্রকোনা চলে যাওয়া যায়। বিভিন্ন বাহারি নামে অনেক ভালো ভালো গাড়ি ঢাকা থেকে নেত্রকোনার উদ্দেশে প্রতিদিন কিছুক্ষণ পরপরই ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে যায়। আবার ময়মনসিংহ শহর থেকেও ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যেই নেত্রকোনা শহরে পৌঁছে যাওয়া যায়। গাড়িও চলে কিছুক্ষণ পরপর। শুধু বালিশ মিষ্টি খাওয়ার জন্য নেত্রকোনা না গেলেও সেখানে একসঙ্গে রথ দেখে দেখে কলাও বিক্রি করা যেতে পারে।
সেই নেত্রকোনা জেলাতেই বিখ্যাত প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি, সেখানে কবি নির্মলেন্দু গুণেরও বাড়ি। সেখানে রয়েছে সুসং-দুর্গাপুরের বিরিশিরি আদিবাসী কালচারাল সেন্টার। নেত্রকোনা ভ্রমণ করলে অনায়াসেই সে স্থানগুলো ঘুরে দেখে আসা যেতে পারে। কাজেই সুযোগ পেলে আজই ঘুরে আসুন না স্বল্প সময়ের জন্য নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার জন্য।
যদি কোনো কারণে নেত্রকোনা যান, বিখ্যাত বালিশ মিষ্টির স্বাদ নিতে ভুলবেন না যেন!