রূপ-বৈচিত্র্যে ভরপুর বারিক্কা টিলা
যান্ত্রিক এই নগরে ব্যস্ততম দিনে সকাল শুরু হয় ঘড়ির অ্যালার্মে। শনিবার আসতেই মন বিষন্ন হয়ে যায়। আগামীকাল আবার একঘেয়ে জীবনের পদাবলী শুরু। আর ভালো লাগছিল না কোলাহলমুক্ত ও সবুজে ঘেরা কোথাও যাওয়া দরকার। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না। প্রাণ কেমন যেন হায় হায় করছিল। এর মধ্যে হঠাৎ প্রদীপ দাদার কল বেজে উঠল। দাদা আসছে সপ্তাহে সিলেটে আসবে ভ্রমণের নিমিত্তে। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিলাম হঠাৎ মনে হলো সুনামগঞ্জের দিকে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত কোথাও ঘুরতে যাওয়া হবে।
সকাল হতেই না হতে যাত্রা শুরু করলাম নতুন গন্তব্যে। সকাল ৯টার দিকে আমাদের গাড়ি সুনামগঞ্জ অভিমুখে এগিয়ে চলছে। কিন্তু সুনামগঞ্জের কোনো জায়গায় তা ঠিক করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত দারস্ত হলাম আমার অফিস সহকর্মী মুসা ভাইয়ের কাছে। তিনি বারিক্কা টিলার কথা বললেন। তবে সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ পারি দিয়ে পৌঁছাতে হবে বুঝি বারিক্কার টিলায়। যাত্রা পথের সঙ্গীদের অভিমত ওই পথে যাওয়ার।
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে গাছের ছায়া আমাদের অভিভূত করল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম সুনামগঞ্জ শহরে। আমাদের চার চাকার বাহনের কাণ্ডারি পলাশ ভাই বললেন, সুনামগঞ্জ শহর থেকে গাড়িতে গ্যাস ভরে নিতে হবে। শহরের বাইরে গেলে পরে গ্যাস বা তেলের কোনো পাম্প নাও পাওয়া যেতে পারে। তাই আমরা গাড়িতে গ্যাস ভরার উদ্দেশে একটি সিএনজি পাম্পের সামনে দাঁড়ালাম। সেখানে দেখলাম বিশাল লাইন কিন্তু কিছু করার নেই।
বিরতির মাঝে আমরা খাওয়ার জন্য পাম্পের পাশের এক রেস্তোরায় প্রবেশ করলাম। রেস্তোরার পরিবেশ খুব একটা ভালো না তারপরেও কিছু করার নেই। সেই সকালে বের হয়েছি কিন্তু পেটে দানাপানি কারো পরে নাই। পরোটা, সবজি ও চা-এর অর্ডার দিল প্রদীপ দা। কিছু সময় পর আমাদের মাঝে পরিবেশন করা হলো খাবারসমূহ। অনেক সময় পরে পলাশ ভাই গাড়িতে গ্যাস ভরতে পারলেন।
এবার আমাদের বারিক্কা টিলা অভিমুখে যাওয়া শুরু করলাম। মুসা ভাই আগেই বলেছিলেন প্রথমে আমাদের জাদুকাটা নদীর তীরে যেতে হবে। এরপর সেখান থেকে নৌকা করে পার হয়ে ইঞ্জিনচালিত যান করে যেতে হবে বারিক্কার টিলায়। আমরা চলছি পিচ ঢালা পথে, কিন্তু একটু পর পর পলাশ ভাই রাস্তার পাশে এক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলেন জাদুকাটা নদীর তীরে যাওয়ার রাস্তা কি ঠিক আছে? আমি মনে মনে অবাক হলাম একটি দর্শনীয় স্থান কিন্তু কোথাও কোনো পথের নির্দেশনা নেই। কিন্তু আমরা অন্য দেশের দিকে চোখ ফেললে দেখব শুধুমাত্র পর্যটন শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। কিন্তু আমার দেশ এক্ষেত্রে একদম পিছিয়ে রয়েছে।
যাই হোক পথের বিড়ম্বনা ভোগের পরে আমরা এসে পৌঁছালাম যাদুকাঁটা নদীর তীরে। অসাধরণ রূপ জাদুকাটা নদীর। যেন চোখের পাতা ফেলতে মনে চায় না। একপাশে বাংলাদেশের সীমান্ত, ওপাশে ভারতের মেঘালয়, খাসিয়া পাহাড়। চিত্রপটে আঁকা এক অপূর্ব ক্যানভাস। আমাদের সঙ্গে সর্ব কনিষ্ঠ ভ্রমণ সঙ্গী আদৃতা খুব খুশি একটু পর পর বাবার মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছে।
আমরা ধূ ধূ বালুময় পথ পেড়িয়ে এগিয়ে গেলাম নৌকার ঘাটের দিকে। সেইসঙ্গে সূর্যের প্রখরতা আমাদের একটু সইতেই হলো। নৌকার ঘাটে এসে এবার নৌকার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। সেইসঙ্গে বেশকিছু যানবাহনও ওপারে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। অপরূপা সীমান্ত নদী জাদুকাটা। এই নদীর পানি এমনই স্বচ্ছ, নিচের বালি স্পষ্ট দেখা যায়। যেন বালি ও পানি খেলা করছে। অপেক্ষার পালা শেষ করে আমরা বড় একটি নৌকায় উঠলাম। একইসঙ্গে নৌকাটিতে মোটরসাইকেল, ঠেলাগাড়ি উঠানো হলো। আমি একটু ভয় পেলাম। কারণ আমি সাঁতার না জানায় অল্প পানি দেখলেই বুকটা কেঁপে ওঠে। যাইহোক ফেরির মাঝি আমাদের ওপারে পৌঁছে দিলেন।
ফেরির থেকে নেমেই আমরা তিন চাকার বাহন নিয়ে নিলাম বারিক্কার টিলা দর্শনের উদ্দেশে। গ্রামীণ ধুলো মাখা পথে আমরা এগিয়ে চলছি। উঁচু নিচু পথ পারি দেওয়া একটু কষ্টসাধ্য, তবে নতুন গন্তব্যে যাওয়ার আনন্দে সে সবকিছু তুচ্ছ। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পথ পারি দিয়ে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো।
এবার আমরা সবাই নেমে হাঁটা শুরু করলাম। হেঁটে যত ওপরের দিকে উঠছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের ততো বিমোহিত করছিল। মেঘালয় পাহাড়ে হাত বাড়ালেই মনে হয় মেঘগুলো ধরা যাবে। পাহাড়ের গায়ে নানা রঙের মেঘের খেলা। মেঘ কখনো সবুজ পাহাড়কে ডেকে দিচ্ছে, আবার কখনো তার রূপে বিলিয়ে দিচ্ছে তার আপন ভালোবাসায়। পাহাড় আর মেঘের সম্মিলনে এক অপরূপ শোভা। আমরা টিলায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
বারিক্কার টিলায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখে মনে হবে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন, যা আপনাকে বারবার স্মৃতির পাতায় নিয়ে যাবে। কথা হলো ওই এলাকার এক প্রবীণ লোকের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই বারিক্কা টিলা বাংলাদেশের মানচিত্রে যেন স্বর্গের অংশ। একদিকে সবুজ পাহাড়, হাওরে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বিল, নদী। বর্ষায় পাহাড়ি রূপবতী জাদুকাটার বুকে স্রোতধারা। আর হেমন্তে শুকিয়ে যাওয়া জাদুকাটার বুকজুড়ে ধূ ধূ বালুচর। আইফেল টাওয়ার খ্যাত বারিক্কা টিলা থেকে ১২ মাস বিভিন্ন রূপ-বৈচিত্র্য উপভোগ করা যায়।
পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সারি সারি উঁচু-নিচু খাসিয়া পাহাড়, সবুজ বনায়ন এবং মাটিয়া পাহাড়, যা প্রতিনিয়ত ছুটে আসা লোকজনের দৃষ্টি কাড়ে। এখানে রয়েছে হরেক রকম গাছ-গাছালি, রয়েছে বিশাল বনভূমিতে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে বলীয়ান আদিবাসী ও বাঙালি বসতি। রয়েছে তাদের নিজেদের গোছানো বাড়িঘর ও ফসলি জমি।
আদিবাসীদের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আপনি যখন বারিক্কা টিলায় উঠবেন, তখন মনে হবে বাংলার আইফেল টাওয়ার থেকে পুরো তাহিরপুর উপজেলাকে দেখছেন। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে গ্রামগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু তখন আপনার চোখের সামনে অপার্থিব হয়ে উঠবে।
কীভাবে যাবেন
বারিক্কা টিলা বা বারেক টিলা দেখতে চাইলে প্রথমে সুনামগঞ্জ যেতে হবে। প্রতিদিন ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে মামুন ও শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায় এবং মহাখালী থেকে ছেড়ে যায় এনা পরিবহন।