অনিয়মিতদের ফেরাতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওপর ইইউর চাপ
অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত না নেওয়া দেশগুলোর ওপর ভিসা কঠোরতা আরোপ করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ সেইসঙ্গে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া উন্নততর করতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নতুন চুক্তির পরিকল্পনাও করেছে তারা৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে যেসব আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন বাতিল হয়ে গেছে, তাদেরকে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের সংখ্যা বাড়াতে চায় ইইউ৷ এজন্য বিদ্যমান যে প্রক্রিয়া আছে, তার ‘পূর্ণ ব্যবহার’ করা হবে বলে জানিয়েছেন সুইডেনের অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রী মারিয়া মলমের স্ট্যানেরগার্ড৷
বৃহস্পতিবার মারিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে কাঙ্খিত ফল দিচ্ছে না৷ এই বিষয়ে কাউন্সিলের কাছে ভিসা কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব জমা দিতে ইউরোপীয় কমিশনকে আহ্বান জানিয়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো৷’ এই বিষয়ে বৃহস্পতিবার স্টকহোমে বৈঠকে সদস্যরা একমত হয়েছেন বলেও জানান তিনি৷
বর্তমানে সভাপতি হিসাবে ইইউ বৈঠকের নেতৃত্ব দিচ্ছে সুইডেন৷ দেশটির কট্টর-ডানপন্থি সরকার অনিয়মিত অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে ভিসা, পররাষ্ট্রনীতি ও উন্নয়ন সহযোগিতাকে শর্ত হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে ইইউকে আগে থেকেই চাপ দিয়ে আসছে৷
অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ইইউর কঠোর অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জোট কমিশনের প্রধান উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনের বক্তব্যেও৷ ফেব্রুয়ারিতে স্টকহোমে জোটের সম্মেলন শুরুর আগে ইইউ দেশগুলোর নেতাদের কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে রাখার কথা উল্লেখ করেন৷
লাইয়েন জানান, বছরের প্রধমার্ধে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি পাইলট প্রকল্পে স্বাক্ষর করতে পারে৷ এই প্রকল্পের উদ্দেশ হলো—আশ্রয় আবেদন ও যোগ্য প্রার্থীদের আশ্রয় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং যারা যোগ্যতা অর্জন করবেন না তাদের অবিলম্বে ফেরত পাঠানো৷
অভিবাসীরা যেসব দেশ থেকে আসেন সেগুলোর মধ্য থেকে ‘নিরাপদ দেশের’ একটি তালিকা তৈরির প্রস্তাব তার৷ অর্থাৎ, যেসব দেশ নিরাপদ বিবেচিত হবে সেসব দেশের আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা তখন কমে যাবে৷ সেইসঙ্গে ভূমধ্যসাগর ও বলকান অভিবাসন রুটে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার কথাও বলেন তিনি৷
কিছু দেশের সঙ্গে নতুন করে প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত চুক্তির পরিকল্পনা কথাও জানিয়েছেন ইইউ কমিশন প্রধান৷ বার্তা সংস্থা এএফপি লাইয়েনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ‘ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া উন্নততর করতে.... ও বহির্গমন প্রতিরোধ’ করতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশর, মরক্কো, তিউনিশিয়া এবং নাইজেরিয়ার সঙ্গে অভিবাসন চুক্তি করার পরিকল্পনা করেছে ইইউ৷
ইইউ স্বরাষ্ট্র কমিশনার ইলভা ইয়োহানসন বলেন, ‘গত বছর প্রায় দশ লাখ আশ্রয় আবেদনের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যাপক চাপে রয়েছে৷ এর বাইরে ইউক্রেন থেকে ৪০ লাখ শরণার্থীর আগমনে দেশগুলোর আশ্রয়ের সক্ষমতা আরো হ্রাস পেয়েছে৷’
নিয়ম অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের পর অনিয়মিত অভিবাসীরা জোটভুক্ত দেশগুলোতে আশ্রয় আবেদনের সুযোগ পান৷ প্রথমবার আবেদন বাতিল হলে তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগও রয়েছে৷ এরপরও তা বাতিল হলে ফেরত যাওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়৷ এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়াদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা সহায়তা প্রকল্প রয়েছে৷ এই সুযোগ নিয়ে কেউ ফেরত না গেলে তাকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠাতে পারে দেশগুলো৷
তবে, ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফেরত যাওয়ার নির্দেশের তুলনায় কার্যকর প্রত্যাবর্তনের হার অনেক কম৷ ২০২১ সালে তিন লাখ ৪০ হাজার ৫০০ জনকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশের বিপরীতে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ৷
গত কয়েক বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অনিয়মিত উপায়ে বাংলাদেশিদের অভিবাসন বেড়েছে৷ বর্তমানে সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগর হয়ে পাড়ি জমানোদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির নাগরিকেরা৷ এ ছাড়া বলকান রুট হয়েও ইইউ সদস্য দেশগুলোতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন অনেকে৷ তাদের মধ্যে আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া কয়েকশো জনকে গত কয়েক বছরে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে জার্মানি, গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশ৷
অভিবাসীদের ফেরত নিতে ঢাকার ওপরে ব্রাসেলসের চাপ রয়েছে৷ বৈধ কাগজবিহীন অভিবাসীদের ফেরাতে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ২০২১ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশিদের ভিসা প্রক্রিয়ায় সাময়িক কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব করে ইউরোপীয় কমিশন৷ এই প্রস্তাবে বাংলাদেশ ছাড়াও ইরাক এবং গাম্বিয়াকেও সেসময় যুক্ত করা হয়৷
বার্তা সংস্থা এএফপি অবশ্য জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ইইউ শুধু গাম্বিয়ার ওপরই ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করেছে৷ এতে দেশটির নাগরিকদের জন্য শেঙেন ভিসা পাওয়া কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়েছে৷ বাংলাদেশ ও ইরাকের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও তা কার্যকর হয়নি৷
গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরকালে ইলভা ইয়োহানসন বলেছেন ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকির পর ঢাকা অনিয়মিত অভিবাসীদের গ্রহণে ‘রাজনৈতিকভাবে আরও উদার’ হয়েছে৷
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বৈধ কাগজবিহীন অভিবাসীদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউর স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি হয়৷ তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময়ে চাপ দিয়ে এসেছে ইইউ৷