ইরানে ‘শত্রুরা খেলছে’, নিহত বাড়ছে
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারি আর নানা নিত্যদিনের অসন্তোষ নিয়ে দানা বাঁধা ইরানের তারুণ্যনির্ভর বিক্ষোভ একদিকে যেমন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক বার্তা দিতে শুরু করেছে, ঠিক একই সময়ে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা।
টানা ছয় দিন ধরে চলা এ বিক্ষোভে সর্বশেষ ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে থমসম রয়টার্স। যদিও ইরানের সরকার ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতারা এই বিক্ষোভের পেছনে দেশটির ‘শত্রুদের ইন্ধন’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।
তেহরানের ডেপুটি রাজ্য গভর্নর জানিয়েছেন, শুধু রাজধানী থেকেই গত তিন দিনে সাড়ে চারশ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরো একশজনকে।
বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, এদের অনেককে বিচারে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শহর আহভেজ থেকে একজন বাসিন্দা টেলিফোনে রয়টার্সকে বলেন, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য প্রথমে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে, পরে রাস্তার দুই পাশের দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। শতাধিক বিক্ষোভকারীকে সরিয়ে দিয়ে তারা রাস্তা ফাঁকা করে দেয়।
এদিকে সরকারি টেলিভিশনে দাবি করা হয়েছে, ইসফাহান প্রদেশে সোমবার রাতে বিক্ষোভের সময় নয়জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের বরাত দিয়ে আরো বলা হয়, এর মধ্যে ছয় বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন গুলিতে। তাঁরা প্রদেশের খাদেরিজন এলাকায় একটি পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালাতে গিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন সশস্ত্র।
জনজীবনের সংকট নিয়ে শুরু হওয়া প্রতিবাদ বিক্ষোভ রাজনৈতিক দিকে মোড় নেওয়ার পেছনে ইরানের ‘শত্রুদের’ হাত রয়েছে অভিযোগ করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। বিক্ষোভ শুরুর পাঁচ দিন পর তিনি প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে বক্তব্য দিলেন।
আয়াতুল্লাহ আল খামেনি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে অস্থির করে তুলতে সাম্প্রতিককালে তার শত্রুরা অর্থ, অস্ত্র, রাজনীতি ও বুদ্ধিসহ নানাবিধ জিনিস নিয়ে মাঠে নেমেছে।
যদিও আয়াতুল্লাহ খামেনি তাঁর বক্তব্যে কারো নাম উল্লেখ করেননি, তবে ইরানের সুপ্রিম কাউন্সিলের (প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ ফোরাম) সচিব আলি শামসখানি বলেছেন, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আসলে ‘শত্রু’ বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর সৌদি আরবকেই বুঝিয়েছেন। তারাই এই বিক্ষোভ নিয়ে খেলছে।
এর জবাব অবশ্যই সৌদি আরবকে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন আলি শামসখানি।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিক্ষোভে বাইরের ইন্ধন অস্বীকার করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত নিক্কি হেলি বলেছেন, ‘আমরা সবাই জানি এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন।’
‘ইরানের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিক্ষোভ করছে। শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত সাধারণ মানুষের জেগে ওঠার সুস্পষ্ট চিত্র এটি’, যোগ করেন নিক্কি হেলি।
গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাশহাদ শহরে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। সেখানে ‘কয়েক হাজার’ বিক্ষোভকারী অংশ নেয় বলে জানিয়েছে সরকারবিরোধী কয়েকটি দল। পরদিন রাজধানী তেহরান, কারমানশাহ ও মাশহাদ শহরে এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালের পর একে সবচেয়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ বলে মনে করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে একই রকমের এক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ইরান সরকার কঠোরভাবে দমন করেছিল।
গত কয়েক দিনে ইরানে প্রধান প্রধান কয়েকটি খাদ্যের মূল্য শতকরা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)।
বিক্ষোভের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বিবিসি জানায়, অর্থনৈতিক অসংগতির জের ধরে বিক্ষোভ শুরু হলেও পরে তা অনেকটা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের দেশটির প্রেসিডেন্ট বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা যায়।
ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস জানায়, চলতি বছরে ইরানের মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালে দেশটিতে বেকারত্বের হার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা বিগত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।