লিপস্টিকের ১০০ বছর
সিয়েরা জুমওয়ালট সান ফ্রান্সিসকোর একজন শরীরচর্চার প্রশিক্ষক, যিনি ম্যাক-এর ‘রুবি উ’ রঙের লিপস্টিক ঠোঁটে না লাগিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়েবসাইট অজি ডট কমের এক প্রতিবেদনে সিয়েরা বলেছেন, তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে প্রায় এক দশক আগে লাল রঙের ম্যাট এই লিপস্টিকটি উপহার পেয়েছিলেন তিনি। এর পর থেকে এই লালরংটি তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
শুধু সিয়েরার কথা বলি কেন? আমাদের বেশির ভাগ নারীই কি লিপস্টিককে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বানিয়ে নেননি? চোখ মেলে দেখুন আশপাশেই এমন অনেকে আছেন যাদের স্ব-পরিচয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে ঠোঁট রাঙানোর এই সামগ্রীটি।
লালকে সাহসের রং বলা হয়। লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর অকুণ্ঠ যৌন আবেদনকেও চিহ্ণিত করা হয়। আবার যে নারীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁদের নারীত্ব বজায় রেখে পুরুষের সমান কাজ করতেন সেই রোজি দ্য রিভেটার্জের কথাও মনে করিয়ে দেয় এই লাল রঙের লিপস্টিক।
লিপস্টিকের আপাত বিরোধী ইতিহাস বেশ দীর্ঘ এবং রঙিন। তবে রং যাই হোক না কেন, যে কোনো সংস্কৃতির ওপর লিপস্টিকের ছাপ ঠিকই রেখে চলেছে।
এবার দেখি, কেন নারীরা গোবরে পোকা পিষে তৈরি রং বা প্রক্রিয়াজাত করা গরুর চর্বি দিয়ে নিজেদের ঠোঁট রাঙাতে আগ্রহী হলেন? শুরুতে যাঁর কথা বলছিলাম, সেই সিয়েরার মতে, লিপস্টিক দিয়ে বাইরে গেলে তিনি নিজেকে শক্তিশালী অনুভব করেন। পৃথিবীর সব সমস্যা মোকাবিলা করতে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে শেষ যে কাজটা তিনি করেন, সেটা হলো ঠোঁট দুটি লিপস্টিকে রাঙানো। লিপস্টিকের টিউবের মুখ খোলা এবং বন্ধ করার এই কাজটি তাঁর প্রতিদিনটার অভ্যাসে এক ধরনের স্বস্তি দেয়। তাই এটা এখন মেকআপ বা রূপচর্চার সামগ্রীর চেয়ে অনেক বেশি কিছু। লিপস্টিক এখন আত্মবিশ্বাস, বিলাস কিংবা ভোগলিপ্তারও প্রতীক। কখনো কখনো এটা একধরনের বর্ম বা কবচও বটে।
লিপস্টিকের সঙ্গে নারীদের সম্পর্ক অনেক প্রাচীন। এটা জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে বেশ পেছনের দিকে। যেতে হবে প্রাচীন মিসরে, যেখানে মিসরীয়রা লাল মাটি ও আয়রন অক্সাইড মিশিয়ে তাদের মুখে আঁকিবুঁকি করত। তখন অবশ্য এটিকে দেখা হতো আভিজাত্যের ভূষণ এবং একই সাথে পাপ চিহ্ণিত করার লাল রং হিসেবে।
ভিক্টোরিয়ান যুগে, যখন নারীত্বকে শিশুসুলভ সরলতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হতো এবং নারীকে তাঁর সৌন্দর্যের জন্য পুরস্কৃত করা হতো, তখন গাঢ় লাল রঙের মলম বা বাম ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০ শতকে লিপস্টিকের জনপ্রিয়তা ফিরে না আসা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল।
নিষেধের অসংখ্য বেড়াজাল পেরিয়ে একসময় হলিউডও তাদের মূলধারার সিনেমায় লিপস্টিকের ব্যবহার শুরু করতে পেরেছিল। যখন কিছু নারী বাড়ির ভেতরে গোপনে লিপস্টিক লাগিয়ে নিজেকে আনন্দ দিতেন, তখন অভিনেত্রীরা পর্দায় ঠোঁট রাঙানো শুরু করলেন। সে সময় সারাহ বেনহার্ডট, যাঁকে বিশ্বের জনপ্রিয়তম অভিনেত্রী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, তিনি একবার লালগালিচা সংবর্ধনায় দুই ঠোঁট লাল রঙে রাঙিয়ে উপস্থিত হলেন। এরপর অন্য নারীদের তাঁকে অনুসরণ করা ছিল কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার।
১৯ শতকের শুরু পর্যন্ত ঠোঁটে লাগানোর এই মলম বা বামগুলো লাল এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ বা পোকামাকড় শুকিয়ে তার নির্যাস থেকে বের করা হতো। এবং তুলির সাহায্যে ঠোঁটে লাগানো হতো। ১৯১৫ সালে প্রথম সিলিন্ডারের মতো টিউবে ভরে লিপস্টিক তৈরি শুরু হয়। সেই থেকে ইসটি লাউডার থেকে শ্যানেল বা এলিজাবেথ আরডেন সবাই এভাবেই লিপস্টিক তৈরি করতে শুরু করে। ১৯৩৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমস ঘোষণা করে, পোশাক যেমন প্রয়োজনীয় তেমনি লিপস্টিকও প্রয়োজনীয় এবং খাদ্যের মতোই অত্যাবশ্যক বিষয়। ১৯৪০-এর দশকে প্রায় ৯০ শতাংশ মার্কিন নারী লিপস্টিক ব্যবহার করতেন।
এলি, রিডবুক, হার্পারস বাজারের মতো নারীবিষয়ক সাময়িকীর সাংবাদিক ও শিল্প নির্দেশক ভেরোনিক ভিয়েনি লিপস্টিকের প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা শুধুমাত্র লিপস্টিক নয়, এটা এক ধরনের আইকন, যা ছিল এবং আছে।’
অন্যান্য ফ্যাশন ও মেকআপের মতো লিপস্টিক ব্যবহারেও অনেক পরিবর্তন-পরিমার্জন এসেছে। বেশির ভাগ লিপস্টিকেই মোম, তেল, চর্বি ও রঞ্জক পদার্থ থাকে। কয়েক বছর আগ পর্যন্তও গরুর মগজ থেকে পাওয়া চর্বি লিপস্টিক তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। কারণ এটি তুলনামূলক সস্তা এবং এতে যথাযথ মসৃণতা পাওয়া যায়। এখন এই প্রলেপে ঠোঁটের নমনীয়তা ধরে রাখতে ভিটামিন ই এবং অ্যালোভেরা ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন গাছ, প্রাণী, খনিজ বা কৃত্রিম রং মিশিয়ে লিপস্টিকের রং ও এর বিভিন্ন শেড তৈরি করা হয়। সেটা শ্যানেল ব্র্যান্ডের ক্ল্যাসিক কোকো হোক আর আরবান ডিকের এফ-বম্ব হোক। তবে যে ব্র্যান্ডেরই হোক না কেন, ঠোঁট রাঙাতে আসার মুহূর্তে লিপস্টিকের বৃত্তাকারে ঘুরে ওপরে উঠে আসার বিষয়টা লিপস্টিকপ্রেমী কে কোনো নারীরই ভাবতে ভালো লাগে।
এখন পর্যন্ত লিপস্টিকই এমন একটি ফ্যাশন অনুষঙ্গ, যা একজন মা প্রথম তাঁর কিশোরী বা তরুণী মেয়ের হাতে তুলে দেন। এমনকি যেসব নারী আইশ্যাডো বা ফাউন্ডেশনের মতো মেকআপের সাধারণ অনুষঙ্গগুলো ব্যবহারও ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁরাও লিপস্টিক ছাড়তে পারেন না। লিপস্টিক ছাড়া অন্য কোনো সৌন্দর্যচর্চার সামগ্রী নেই যার একটি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। লিপস্টিক সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী মত দিয়েছেন অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর। তিনি বলেন, ‘নিজেকে তরলে ডোবাও, কিছু লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙাও এবং নিজেকে একসঙ্গে টেনে তোলো।’
পুশ-আপ টিউবে ভরে লিপস্টিক ব্যবহার শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১০০ বছর আগে। এই লিপস্টিক শুধু নিজেই ওপরে ওঠেনি, সে নারীকেও অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে টেনে তুলতে সাহায্য করেছে। লিপস্টিক নিজেকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে নারীকে। লিপস্টিক ব্যবহার করে যেন নারী বলতে পেরেছে, আমি জানি আমি কে এবং নিজেকে প্রকাশ করতে আমি একটুও ভীত নই। তাই ১০০ বছর পর এসে আজ অনেক নারীই বলেন, ‘লিপস্টিক ব্যবহার না করে আমি থাকতেই পারি না।’