বর্বর মানববর্ম তৈরি করে পালাচ্ছে আইএস
সিরিয়ার দখলকৃত বিভিন্ন শহর থেকে পালানোর সময় স্থানীয় মানুষদের বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সম্প্রতি সিরিয়ার উত্তরের মানবিজ শহর দখলমুক্ত করার সময় দেখা গেছে এই বর্বর ঘটনা।
আজ শুক্রবার মানবিজ থেকে মানববর্মের আড়ালে আইএসের সৈন্যদের পালানোর কয়েকটি ছবি প্রকাশ করেছে বিবিসি অনলাইন। যাতে দেখা গেছে আইএসের গাড়িবহরের সুরক্ষায় গাড়ির পাশে এবং ভেতরে রয়েছে সাধারণ জনতা। যাদের বিপজ্জনক এলাকাগুলো পার হওয়ার সময় বন্দি হিসেবে গুলির সামনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
গত সপ্তাহে মার্কিন সমর্থিত,সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স, শুক্রবার, মানবিজ শহরটি দখল করে। বিমান হামলার মাধ্যমে শহরটিতে থাকা আইএসের স্থাপনাগুলো ধ্বংসের পর আইএস যোদ্ধারা সেখান থেকে পালিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরেকটি শহরের দিকে চলে যায়। কিন্তু যাওয়ার পথে গাড়িবহর এবং নিজেদের নিরাপত্তায় মানবিজ থেকে দুই হাজারের বেশি মানুষকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যায়।
বিবিসির প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে,আইএসের গাড়িবহরের সঙ্গে হাঁটছেন ওই মানুষগুলো। যাতে সিরীয় অথবা মার্কিন বাহিনী গুলি করলে গুলিগুলো প্রথমে ওই সাধারণ মানুষদের গায়েই লাগে।
সিরিয়ায় থাকা এক জ্যেষ্ঠ্য মার্কিন সেনা কর্মকর্তা জানান,ওই মানববর্ম তৈরির কারণেই পাঁচশর বেশি গাড়িবহর নিয়ে আইএসের সৈন্যরা পালাতে পেরেছে। সাধারণ মানুষের গায়ে গুলি লাগার ভয়ে ভারী অস্ত্র চালাতে পারেনি যোদ্ধারা।
আর মানববর্ম থেকে মুক্তি পাওয়া মানবিজের এক নাগরিক জানান, গাড়িভর্তি অস্ত্র রক্ষায় অস্ত্রের উপরে সাধারণ মানুষদের বেঁধে নিয়েছিল আইএস সেনারা।
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে,আইএস সদস্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের নিয়ে অন্তত পাঁচশ গাড়ি মানবিজ শহর থেকে বেরিয়ে গেছে। তাদের গন্তব্য এখন উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জারা ব্লুস শহর। তুরস্ক সীমান্তের কাছে এ শহর এখন আইএসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আর গত শনিবার মার্কিন বাহিনী জানিয়েছিল,ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অবশিষ্ট জঙ্গিরা চলে যাওয়ার পর সিরিয়ার মানবিজ শহর যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহী দল সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
এদিকে গত সপ্তাহে আইএসের কথিত শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর মানবিজ শহরের অধিবাসীরা উৎসবের মতো করে তা উদযাপন করছে। রাস্তায় নেমে হাসিমুখে তারা আনন্দ উল্লাস করছে।
এর আগে বিবিসির প্রকাশ করা ছবিতে অনেকে পুরুষকে হাসিমুখে তাদের দাঁড়ি কামিয়ে ফেলতে দেখা যায় আবার কেউ কেউ ধূমপান করছিলেন প্রকাশ্যে। এসব অধিকার থেকে গত দুই বছর বঞ্চিত ছিল তারা।
মানবিজের অধিবানীরা জানান,আইএস যত দিন ছিল তত দিন এ শহরের নারীদেরই মুখ ঢেকে যেমন চলতে হতো,আবার পুরুষদের দাড়ি পর্যন্ত কামাবার অনুমতি ছিল না।
সিরিয়ায় তুরস্কের সীমান্তের কাছে মানবিজ শহর। ২০১৪ সালে এটি দখল করে দমন-পীড়ন শুরু করে আইএস। তাদের বিতাড়িত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট আরব ও কুর্দি যোদ্ধারা টানা ৭৩ দিন যুদ্ধ করে। আইএসের হাতে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহৃত দুই হাজার লোকও মুক্ত হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে যারা ছিল মৃত্যুর আতঙ্কে, মুক্ত হয়ে তারা বাঁধভাঙা আনন্দে আত্মহারা।
মানবিজে এক নারীর সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স জানতে পেরেছে এমন একটি স্থানের কথা যেখানে লোকজনকে নানা অজুহাতে শিরশ্ছেদ করা হতো। ওই নারী জানিয়েছেন,যেকোনো কারণে অথবা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না,এমন অজুহাতে তারা মানুষের মাথা কেটে ফেলত !
গত কয়েক মাসের টানা লড়াইয়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর মানবিজ। বিদ্রোহীদের ওপর রুশ ও সরকারি বাহিনীর অব্যাহত বিমান হামলা এবং আইএস-বিদ্রোহী সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে শহরটির অধিকাংশ এলাকা থেকেই পালিয়েছেন বাসিন্দারা। মানবিজ মুক্ত হওয়ার পর একই দিনে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত শহর ইদলিবেও কয়েক দফা বিমান হামলা হয়েছে। এতে অন্তত ২ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ হামলার জন্য সরকারি বাহিনীকে দায়ী করেছে সিভিল ডিফেন্স ফোর্স।
এছাড়া ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সুযোগে ২০১৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস,যারা সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল অঞ্চল দখল করে খিলাফত ঘোষণা করে,যার রাজধানী সিরিয়ার রাকায়। সিরিয়ার সরকার ও বিদ্রোহীরা একই সঙ্গে দুটি যুদ্ধ চালাচ্ছে। সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয় আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে এবং একই সঙ্গে তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করছে।
সিরিয়ার বিশাল অংশে এখনো আইএস তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাদের নির্মূল করতে যুদ্ধের ময়দানে আছে রাশিয়া,যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য,ফ্রান্সসহ প্রায় ৬০টি দেশের সামরিক শক্তি।