বিক্ষোভে উত্তাল তুরস্ক, এরদোয়ানের পদত্যাগ দাবি

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করেছে দেশটির হাজারো মানুষ। জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও রাজধানী ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোলুকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দেশটির প্রেসিডেন্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
শনিবার (২২ মার্চ) বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার (২১ মার্চ) ইস্তানবুলে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর পেপার স্প্রে, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। রাজধানী আঙ্কারা ও ইজমির শহরেও বলপ্রয়োগে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। আঙ্কারায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা একটি প্রধান সড়ক ধরে অগ্রসর হতে গেলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
এর আগে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে স্থানীয় সময় বুধবার (১৯ মার্চ) ইমামোলুসহ বেশ কয়েকজন বিরোধী দলীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে তুরস্কের পুলিশ। এর পরপরই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ইস্তানবুলসহ দেশটির নানা প্রান্তে।
এ ঘটনাকে ২০১৩ সালের পরে সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন অনেকে। সে বছরের আন্দোলন চলাকালে অন্তত আট জন নিহত হয়েছিলেন।
এবার অবশ্য বিক্ষোভ দমনে ইস্তানবুলের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির প্রশাসন। এ ছাড়া বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া শহরগুলোতে সব ধরনের জমায়েতের ওপর পাঁচ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঘটা সহিংসতার কারণে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অবস্থিত একটি মেট্রো স্টেশনও বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন।
দেশটির প্রশাসনের এমন বাধা ও প্রেসিডেন্টের হুমকির তোয়াক্কা না করেই আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন বিক্ষোভকারীরা। এমনকি, এরদোয়ানের শাসনকে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনা করে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে তাকে সরে দাঁড়ানোর দাবি তোলেন অনেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের অর্থনীতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এতে দেশটির নাগরিকদের একটি বড় অংশ অভিবাসনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
২০২৩ সালে পরিচালিত একটি জরিপের তথ্য দিয়ে মিডলইস্ট আইয়ের খবর বলছে, দেশটিতে মৌলিক অধিকারসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কারণে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী নাগরিকদের দুই-তৃতীয়াংশ সুযোগ পেলেই দেশ ছাড়তে চায়।
এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে দেশটির সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। আন্দোলনরতদের অভিযোগও তা-ই—দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ঠিকভাবে কার্যকর নেই।
তবে ইমালোলুর বক্তব্যে তারা (বিক্ষোভকারীরা) আশার আলো দেখতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তারের পর দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ৯৭ জনকে আটক করেছে তুরস্কের পুলিশ। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি ইয়ারলিকায়া।
২০২৮ সালে তুরস্কে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই নির্বাচনকে সামনে রেখেই বিরোধীদলীয় নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সমালোচকরা।
দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে, ইস্তানবুলের মেয়রসহ আরও ১০০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন সরকারি কৌঁসুলিরা। আটকদের মধ্যে মেয়র ইমামোলুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুরাত অনগুনও রয়েছেন।
এই নির্বাচনে এরদোয়ানের বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্যতম একরেম ইমামোলু। তিনি যাতে আগামীতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদও বাতিল করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তুরস্কের আইন অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান, সেক্ষেত্রে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকা আবশ্যক।
২০১৯ সালে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হন ইমালোলু। সে সময় তার দলের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে পুনরায় নিবার্চনের আহ্বান করে দেশটির প্রধান নির্বাচন কমিশন। তবে দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে আরও বেশি ভোটে জয়ী হন তিনি। তারপর থেকেই নানা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে এই নেতাকে।
আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংহতি সংগঠনের এক মুখপাত্র বলেন, ইমালোলুর গ্রেপ্তার ও তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিলের ঘটনা গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাত।
তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে তুরস্কের প্রশাসন বলছে, দেশটির আদালত সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। কেউ কোনোভাবে একে প্রভাবিত করতে পারে না।
জুমহুরিয়েত পত্রিকাসহ দেশটির অন্যান্য গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইমামোলুকে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এ সময় তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন বলেও খবরে বলা হয়। আজ (শনিবার) তাকে ফের আদালতে তোলার কথা।
এর আগে, শুক্রবার দেশের নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার আহ্বান জানান দেশটির প্রধান বিরোধী দলের নেতা ওজগুর ওজেল। সে সময় সাংবিধানিকভাবে সঠিক উপায়ে নির্বাচনে ইমামোলুকে হারাতে না পারায় এরদোয়ান আদালতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
আন্দোলন দমনে কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারি
দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুরস্কের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এরদোয়ান। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি শাসকও তিনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার বর্তমান মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত। তবে দেশটিতে তার জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, জননন্দিত নেতা হিসেবে ক্রমেই মজবুত হচ্ছে ইমালোলুর অবস্থান।
দুর্নীতি মামলায় ইমালোলুরকে গ্রেপ্তার করেছে এরদোয়ান প্রশাসন। ইমামোলুকে হেফাজতে নেওয়ার পর তিনি বলেছেন, দেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে যদি কোনো বিক্ষোভ কিংবা আন্দোলন করা হয়, তাহলে সেটি বরদাশত করা হবে না। এ বিষয়ে তিনি কাউকে ছাড় দেবেন না বলেও কড়া হুঁশিয়ারি দেন। এ সময়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিরোধী দলকে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম জড়িত বলে অভিযোগ করেন।
ইমালোলুর বলেন, চুরি, লুটপাট, জালিয়াতির মতো ঘটনায় যারা রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছেন, তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন। এসব আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করা হবে।
বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করার কয়েকদিন আগেই ইমামোলুকে গ্রেপ্তার করা হলো। রোববার ১৫ লাখ ভোটারের অংশগ্রহণে দলীয় নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে ইমামোলুকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রাথমিক নির্বাচন পরিকল্পনা অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন ওজেল।
তা ছাড়া দেশের নাগরিকদের একটি প্রতীকী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্যও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিরোধীরা।
এ দিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইমামোলুকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে তার জায়গায় ট্রাস্টি মেয়র নিয়োগ দিতে পারে প্রশাসন। কারণ তুরস্ক ও তার পশ্চিমা মিত্ররা পিকেকে-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করে।
তবে প্রশাসন এমন সিদ্ধান্ত নিলে আগামী ৬ এপ্রিল একটি বাহ্যিক কংগ্রেস ঘোষণার কথা জানান ওজেল। ২০২৩ সালে গঠিত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে সেটি ভেঙে দিয়ে নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থী নিয়োগ দিতে পারে এরদোয়ান প্রশাসন—এমন গুজবের মধ্যেই নতুন কংগ্রেস গঠনের কথা জানানো হয়।